শুভব্রত আমান/
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো সবজি উৎপাদনে দেশে শীর্ষ হলেও সঠিক দামে সবজি বিক্রয় করতে পারেন না এ অঞ্চলের সবজি চাষীরা। মৌসুমের মাঝামাঝিতেই পড়তে থাকে দাম এবং শেষ পর্যন্ত সবজির দাম ঠেকে যায় একেবারে তলানীতে। প্রতিবছরই মৌসুমের শেষ পর্যন্ত চাষীরা গুণে থাকেন ক্ষতি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সবজির দেশীয় শীর্ষ বাজার হলো রাজধানী শহর। প্রান্তিক জেলাগুলো থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়মিত নির্দ্দিষ্ট পরিমাণ সবজি সেখানে পৌঁছানোর বন্দোবস্ত করতে না পারা পর্যন্ত এ সমস্যা কাটবে না। অন্যদিকে, কৃষকদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকতে হবে কখন কোন ফসল উৎপাদন করলে সঠিক দাম পাওয়া যাবে।
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মধ্যে খুলনা, যশোর ও মেহেরপুরে সবার্ধিক সবজি চাষ হয়ে থাকে। দেশে সবজির চাহিদার বড় অংশ সরবরাহ করেন যশোরের চাষীরা। সবজি উৎপাদনে হেক্টর প্রতি গড় ফলনেও দেশে সর্বোচ্চ এ জেলা। সবজি উৎপাদনে জেলা পর্যায়ে প্রথম যশোর। যৌথভাবে দ্বিতীয় রংপুর, জামালপুর এবং তৃতীয় পাবনা জেলা। এ স্বীকৃতি স্বয়ং কৃষি মন্ত্রণালয়ের।
কৃষি বিভাগের সূত্র মতে, গ্রীস্ম ও শীত উভয় সময় ধরেই যশোর জেলায় সারা বছর সবজির আবাদ হয়ে থাকে। বছরে ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষিরা বিভিন্ন ধরনের সবজির আবাদ করে থাকেন। যা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় আট লাখ টন সবজি। যশোর জেলায় মোট ৩৩ ধরনের সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। এর মধ্যে বেগুন হেক্টর প্রতি উৎপাদন হয় ৩৩ দশমিক ৯৮ টন, পটল ২৩ দশমিক ৩৭ টন, বাঁধাকপি ৪৪ দশমিক ৯৮ টন, ফুলকপি ৩১ দশমিক ৭৮ টন, ওলকপি ৩৪ দশমিক ৯৫ টন, মূলা ৩৪ দশমিক ৫৩ টন, টমেটো ৩৪ দশমিক ৫৬ টন, শিম ১৫ দশমিক ৬৪ টন।
দেশের অন্যতম বৃহৎ সবজির বাজার গড়ে উঠেছে যশোরের বারীনগরে।
কৃষকরা বলছেন, কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে মিলছে না কৃষিপণ্যের দাম। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ প্রান্তিক কৃষক ঋণ করে চাষাবাদ করেন। অনেকে আবাদ করেন বর্গা জমি। পণ্যের প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ায় সে ঋণ পরিশোধ করতে কঠিন সময় মোকাবেলা করতে হয় তাদের।
সম্প্রতি কয়েকজন সবজি চাষীর সাথে কথা হয় যশোরের বারীনগর সবজি বাজারে।
সদর উপজেলার রাশেদ আলী আড়াই বিঘা জমি ৫০ হাজার টাকায় বর্গা নিয়ে সবজি চাষ করেছিলেন। এখন তার খেতে রয়েছে মিষ্টিকুমড়া। তিনি জানান, পাইকাইদের কাছ থেকে প্রতি কেজি মিষ্টিকুমড়ার দাম পেয়েছেন ১২ টাকা। এত কম দামে বিক্রি করে তিনি যে লাভের আশায় কুমড়া চাষ করেছিলেন সে স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তার।
একটি হিসেব দেন কৃষক রাশেদ আলী। তার নিজের জমি নেই। আড়াই বিঘা জমি (৩৩ শতকে বিঘা) বর্গা নিয়ে চাষ করেছেন তিনি। প্রতি বিঘা জমির বর্গা বাবদ বছরে ২৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কয়েক মাস আগে খেতে মূলা চাষ করেছিলেন। কিন্তু বর্ষার কারণে গাছ মারা গিয়েছিল। এক টাকারও মূলা বিক্রি করতে পারেননি। এরপর চাষ করেছেন মিষ্টিকুমড়া। ফলন মোটামুটি ভালো হয়েছে। কিন্তু দাম খুবই কম। বাকিতে জ্বালানি তেল, সার, কীটনাশক কিনেছেন তিনি। দোকানদার ৮০ হাজার টাকা পাবে। সব কুমড়া বিক্রি করেও দেনা শোধ হবে না।
তিনি জানান, কৃষি উপকরণের দাম বেড়েই যাচ্ছে। ফসল ফলাতে খরচ বেশি হয়ে যাচ্ছে। ফসল বিক্রির পর অর্ধেক খরচও উঠছে না। চাষাবাদ ছেড়ে দেয়া ছাড়া উপায় নেই।’
পেঁয়াজ চাষী তাপস কুমার ঘোষ বললেন পাইকারদের সাথে দামের যুদ্ধ করে ৩০ টাকা কেজি দরে তিনি বিক্রি করেছেন পেঁয়াজ। কিন্তু বিক্রির টাকায় উৎপাদন খরচই উসুল হচ্ছে না। ধারদেনা কীভাবে পরিশোধ করবেন, সেটি নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
সদর উপজেলার তীরেরহাট গ্রামের তাপস কুমার ঘোষ এবার এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন। বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রমিকসহ ১ লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তবে বাজারে যে দামে বিক্রি হচ্ছে তাতে খরচ অর্ধেকও উঠবে না।
শীতকালীন সবজি চাষী সদর উপজেলার কলমাপুর গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম এবার দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছেন। প্রতি পিস চারা কিনেছিলেন আড়াই টাকা। অথচ ফুলকপি এখন বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা পিস। চাষে প্রতি বিঘায় ৪০-৪৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ফুলকপি বিক্রি করে ১০ হাজার টাকাও আয় হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে তারা। শিম চাষ করেও খরচের টাকা তুলতে পারেনি তিনি।
সদর উপজেলার দৌলতদিহি গ্রামের কৃষক জামাল হোসেন তরফদার বলেন, ‘তিন বিঘা জমিতে আলু, সাত বিঘায় মূলা, এক বিঘায় পটোল, দুই বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ করেছি। এক বিঘা জমিতে আলু চাষ করতে খরচ হয়েছে ৫০-৫৫ হাজার টাকা। আলু বিক্রি করছেন ১০ টাকা কেজি দরে। এক বিঘা জমির আলু বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার টাকায়। এতে আমার লোকসান হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এখনো ছয় বিঘা জমির আলু তুলতে বাকি রয়েছে। বর্তমান দামে আলু বিক্রি করলে, সাত বিঘা জমিতে লোকসান হবে ২ লাখ টাকা।’
পদ্মসেতু/সবজি ট্রেন
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর কৃষকদের এ ধরনের দুরবস্থা থেকে বাঁচাতে দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন মহল বিভিন্ন সুপারিশ করে আসছিল। তার মধ্যে অন্যতম হলো রাজধানী শহর বা দেশের অন্য যে কোন জায়গায় সবজি বিক্রয়ের সুযোগ। কিন্তু এ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য এটা কঠিন ছিল। দুই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল থেকে সবজি রাজধানীসহ দেশের অন্যত্র যেয়ে থাকে। সরাসারি বাস বা ট্রাক যোগে ও ট্রেনে করে।
ট্রাকে করে সবজি ঢাকা নিতে খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। ্্রক ট্রাক সবজি যশোর থেকে ঢাকা নিতে ২০২২ সালে যেখানে পড়ত ১৮০০ হাজার টাকা। ২০২৫ সালে এসে সেটা দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এর বাইরে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে বিভিন্নভাবে আরও প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার অতিরিক্ত রয়েছে। তারপরও সবজি ঢাকা পৌঁছাতে সময় লেগে যেত ১২/১৪ ঘন্টা। ক্ষেত্র বিশেষে ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত। এতে খরচ আরও বেড়ে যেত ও সবজিতে পচন ধরে যেত।
পদ্মাসেতু নির্মিত হবার পর পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি ঘটে। প্রথম দিকে সবজি পরিবহন খরচ কিছুটা কমে এলেও পরবর্তীতে জ¦ালানীর দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবহন খরচও বেড়েছে। অন্তবর্তী সরকার সবজি ট্রেন চালুর ব্যবস্থা করে। কিন্তু সেটাও সঠিক ব্যবস্থপানার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের কৃষি বিভাগের একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা রয়েছে। কৃষি বিভাগ কৃষকদের সঠিক সময়ে সঠিক ফসল উৎপাদনের পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা বলছেন, উৎপাদিত পণ্যের সহজ বাজারীকরণ এখনও সম্ভব হয়ে উঠেনি। এখনও কৃষকরা নিজ উদ্যোগে ফসল ফলিয়ে থাকে এবং নিজ উদ্যোগেই বাজারজাত করে থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক ড. মোশাররফ হোসেন জানান, সাধারণত কৃষকরা অনুমানের উপর নির্ভর করে ফসল উৎপাদনে নামেন। ভবিষ্যতে ফসলের বাজার দর কোনদিকে যাবে এত তারা ভাবতে চান না। মৌসুমের প্রথম দিকে নতুন পণ্যের দাম বেশী থাকে। সেই দাম দেখে যদি কৃষক একই পণ্য উৎপাদনে নামে মৌসুমের শেষে এসে দাম পাবেন না। এখানে সেটাই ঘটছে।
তিনি বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে চাহিদা বিবেচনায় ফসল চাষাবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। একই ফসল বেশি চাষ না করে, পরিমাণে অল্প হলেও বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষে পরামর্শও দেয়া হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, সরকার কৃষকের পাশে রয়েছে। সারে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে, বীজ দিচ্ছে, নগদ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। সরকার পাইলট প্রকল্পের আওতায় হিমাগার তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। এটি বাস্তবায়ন হলে সবজি সংরক্ষণের সুযোগ পাবেন কৃষক।’
সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর : ড. আমানুর আমান,এম.ফিল (আইইউকে), পিএইচডি ( এনবিইউ- দার্জিলিং)
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শাহনাজ আমান।
কার্যালয়:- থানা ট্রাফিক মোড়, কুষ্টিয়া।মোবাইল- ০১৭১৩-৯১৪৫৭০, ইমেইল: info.dailykushtia@gmail.com
ই-পেপার কপি