শুভব্রত আমান/
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দুটি স্থলবন্দর ভোমরা ও বেনাপোল দিয়ে চালের আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও স্থানীয় বাজারে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং এক মাসের ব্যবধানে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় চালের দাম কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের নির্ধারিত চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়াই দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ। তাদের মতে, চাহিদা অনুযায়ী চাল আমদানি হলে দেশীয় উৎপাদন কম হলেও বাজারে অস্থিরতা দেখা দিত না।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৩ অক্টোবর ২০২৪ থেকে ১৩ মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত ভোমরা ও বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে মোট ১,৫৬,৩১৩ টন চাল আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ভোমরা দিয়ে এসেছে ১,৩৭,৫১৫ টন এবং বেনাপোল দিয়ে ১৮,৮০০ টন। তবে, সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩,৩২,০০০ টন, যার মধ্যে ২,৭৩,০০০ টন সিদ্ধ চাল এবং ১,১৯,০০০ টন আতপ চাল অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আমদানি করা চালের মধ্যে মিনিকেট, নাজিরশাইল, বাসমতী, স্বর্ণা ও জামাইবাবু উল্লেখযোগ্য, যেগুলোর দাম দেশীয় বাজারে বেড়েছে।
ভোমরা কাস্টমস স্টেশনের সিনিয়র রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মইনুল হক জানান, ১৩ অক্টোবর ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত এ বন্দর দিয়ে ১,৩৭,৫১৫ টন চাল আমদানি হয়েছে, যার বাজার মূল্য ছিল ৬৮৬.৮৩ কোটি টাকা।
তবে এত চাল আমদানি হলেও খুলনা বিভাগের দশ জেলার বাজারে দামের ওপর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। সাতক্ষীরা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত চালের দাম উচ্চমাত্রায় রয়ে গেছে, এমনকি ভরা মৌসুমেও।
সাতক্ষীরার চালতেতলা এলাকার তপন অটো রাইস মিলের মালিক তপন কুমার সাহা জানান, তার মিলে সুপার মিনিকেট চাল পাইকারিতে প্রতি কেজি ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, সাধারণ মিনিকেট ৭০ টাকা, আর বাসমতী ৮৪ টাকায়। অন্যান্য চালের মধ্যে চিকন ২৮ বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকায়, চিকন ৬৩ জাতের চাল ৭৫ টাকায় এবং মোটা জামাইবাবু ও স্বর্ণা ৫২ টাকায়।
তিনি বলেন, "ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় তার প্রভাব চালের দামে পড়ছে।"
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, জেলার চাল উৎপাদন চাহিদার তুলনায় ৪০% বেশি হলেও দাম কমছে না।
"আমন ও বোরো মৌসুমে সাতক্ষীরায় অন্তত ছয় লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়, অথচ জেলার সর্বোচ্চ চাহিদা মাত্র চার লাখ টন। তারপরও বাজারে চালের দাম কমছে না," বলেন তিনি।
যশোরের চাল ব্যবসায়ী দীন মোহাম্মদ জানান, রোজা শুরুর পর থেকে চালের দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা বেড়েছে। রোজার আগে ২৮ জাতের চাল ছিল ৬৪ টাকা কেজি, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৬৯ টাকায়। মিনিকেট চাল ৭২ থেকে বেড়ে ৭৬ টাকা, মোটা চাল ৫২ থেকে ৫৬ টাকা এবং বাসমতী ৮৪ থেকে ৮৮-৯০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
"আমদানিকৃত ভারতীয় চাল ৫৮ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, তবে এর প্রতি ক্রেতাদের চাহিদা কম," বলেন তিনি।
এদিকে, দেশের অন্যতম বৃহত্তম চাল মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে সরু চালের বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এখানে মোটা ধান থেকে তৈরি সরু চাল, যেমন ব্রি ধান-২৮, ব্রি ধান-২৯, হাইব্রিড ধান ও কাজল লতার দাম কেজিতে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
অনুমোদিত আমদানির মাত্র এক-চতুর্থাংশ বাস্তবায়িত/
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার ৯২টি শীর্ষ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক দরপত্র ও উন্মুক্ত বাজার পদ্ধতিতে শুল্কমুক্ত চাল আমদানির অনুমতি দেয়।
বন্দর সূত্র জানায়, ২,৭৩,০০০ টন সিদ্ধ চাল এবং ১,১৯,০০০ টন আতপ চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও সীমিত সময়সীমার কারণে পুরো পরিমাণ আমদানি সম্ভব হয়নি।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, আমদানির সময়সীমা মাত্র ২৫ দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে বাজারজাতেরও নির্দেশনা ছিল। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান সময়মতো চাল আনতে পারেনি। এই কারণে সরকার প্রথমে সময় বাড়িয়ে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত করে এবং পরবর্তীতে একাধিকবার সময় বাড়িয়ে সর্বশেষ ৬ মার্চ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আরিফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময়সীমা বর্ধিত করা হয়।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আহ্বান/
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) শামীম হোসেন কে জানান, ভারত থেকে আমদানি করা চালের ট্রাক বন্দরে ঢুকলেই দ্রুত ছাড় করানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে যাতে তা দ্রুত বাজারে সরবরাহ করা যায়।
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান জানান, আমদানি করা চাল দেশের বিভিন্ন জেলায় দ্রুত পৌঁছে গেলেও বাজারে প্রত্যাশিত প্রভাব পড়েনি।
দেশের অন্যতম বৃহৎ চাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়ার খাজানগরের দেশ এগ্রো ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল খালেক বলেন, "সরকার সাধারণত উৎপাদন ও চাহিদা বিবেচনা করে চাল আমদানি করে। তবে এবার উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেশি ছিল।"
তিনি বলেন, "যদি প্রয়োজনীয় পরিমাণ চাল আমদানি না হয়, তবে বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে।"
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর : ড. আমানুর আমান,এম.ফিল (আইইউকে), পিএইচডি ( এনবিইউ- দার্জিলিং)
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শাহনাজ আমান।
কার্যালয়:- থানা ট্রাফিক মোড়, কুষ্টিয়া।মোবাইল- ০১৭১৩-৯১৪৫৭০, ইমেইল: info.dailykushtia@gmail.com
ই-পেপার কপি