দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
৫০ বছর পূর্ণ করছে ফারাক্কা বাঁধ। এটি ভারত দেশে অবস্থিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার আন্তঃসীমান্তে গঙ্গা নদীর গতিপথে নির্মিত হয়েছে এই বাঁধ। বাঁধটি নানা কারনে বিতর্কিত ও আলোচিত ; বাঁধটি দুটি জনপদে একই সময়ে সুখ ও দুঃখের সাথে উচ্চারিত নাম। এই অর্ধ শতাব্দি ধরে বাঁধটি এর গঙ্গার ভাটিতে ব্যাপক বিরুপ প্রভাব ফেলে আসছে।
গঙ্গা নদী/
ভারতের উত্তরাখন্ডের পশ্চিম হিমালয় থেকে উৎপত্তি নিয়ে দক্ষিণ ও পূর্বে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। এক্ষেত্রে এর দুটি ধারা বা শাখা লক্ষনীয়- একটি ফারাক্কা বাঁধ থেকে এসে ভাগীরথী ও হুগলী নদী নামে মূলত দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে; অপরটি বাংলাদেশ সীমান্তে মহানন্দার সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নামে গোয়ালন্দ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। পদ্মাকে মূলত গঙ্গার প্রধান শাখানদী বলা হয়। তবে ঐতিহাসিক কারণবশত এর অববাহিকাকেও গাঙ্গেয় বদ্বীপের অন্তর্গত বিবেচনা করা হয়। জলপ্রবাহের ক্ষমতা অনুযায়ী গঙ্গা বিশ্বের প্রথম ২০টি নদীর একটি। গাঙ্গেয় অববাহিকার জনসংখ্যা ৪১ কোটি। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নদী অববাহিকা। এটির মহান চরিত্র হলো এটি একটি অভিন্ন নদী।
এই নদীর উপর ২ হাজার ২৪০ মিটার লম্বা এ বাঁধের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬১ সালে, শেষ হয় ১৯৭৫ সালে।
এ বাঁধের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক পরিবেশগত ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটেছে। বিতর্কিত এ বাঁধের কারণে বহু নদীর মৃত্যু, জীবন-জীবিকা ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসহ বহুমাত্রিক প্রভাব বিবেচনায় বাংলাদেশ এমনকি ভারতের কিছু অংশেও এর জোরালো বিরোধিতা রয়েছে।
অর্ধশতাব্দী ধরে ফারাক্কা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান অভিযোগ—এ বাঁধের ফলেই প্রমত্তা পদ্মার বুকে জেগেছে বিশাল চর, সংকীর্ণ হয়ে গেছে নদীর গতিপথ। শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত পানি সরিয়ে নেয়ায় পদ্মায় মারাত্মক পানি সংকট তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের প্রধান এ নদী। অন্যদিকে ভারত বরাবর যুক্তি দিয়ে এসেছে, কলকাতা বন্দরকে রক্ষার জন্য ফারাক্কা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
ফারাক্কা চালু হওয়ার দুই দশকেরও বেশি সময় পর ১৯৯৬ সালে ভারত ও বাংলাদেশ যে ঐতিহাসিক গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে অবশ্য ভাগীরথী ও পদ্মায় গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটা ফর্মুলায় দুই দেশ একমত হতে পেরেছিল। ৩০ বছর মেয়াদি সে চুক্তির কার্যকালও প্রায় শেষের পথে। চুক্তি নবায়ন নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে ফারাক্কা নিয়ে বিতর্ক, বিরোধ বা দোষারোপের পালা কিন্তু কখনই থামেনি।
গত ৫০ বছরে ফারাক্কা ব্যারাজ বাংলাদেশের নদ-নদীতে যে বিরূপ প্রভাব রেখেছে তার বড় সাক্ষী পদ্মাপাড়ের মানুষ। শুষ্ক মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখা যায় ধু-ধু বালুচর। আবার বর্ষাকালে ফারাক্কার সব গেট খুলে দেয়া হচ্ছে। এতে প্রায় প্রতি বছরই গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখা দিচ্ছে বন্যা ও ভাঙন।
পদ্মা নদীতীরবর্তী হাকিমপুরের বাসিন্দা ৭০ বছরের বৃদ্ধ মোহাম্মদ সানাউল্লা। ফারাক্কা বাঁধের আগে-পরে পদ্মার চরিত্র ও পানিপ্রবাহ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে অনেক স্রোত ছিল, নদী বড় ছিল। এখন তো পুরো চর। যখন বাঁধ ছিল না তখন পানির খুব বেগ, ক্ষমতা আর স্রোত ছিল। এ নদীর একটা পাড়ে নৌকা ভেড়াতে চারজন লোকও ঘাবড়ে গেছে, কারণ পানির এত স্রোত ছিল। এখন তো শুধু ডাঙ্গা।’
ছোটবেলা থেকেই রাজশাহী এলাকায় পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করেন মোহাম্মদ রাব্বির হোসেন। কিন্তু নদীর পানি কমে যাওয়ায় মাছও আগের মতো পাওয়া যায় না। এমনকি অতীতে তারা যেসব মাছ পেতেন, এখন আর তা ধরা পড়ে না। অনেকে তাই মাছ ধরা পেশা ছেড়ে দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
নদী গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী পদ্মার গতিপথ থেকে শুরু করে এর শাখা নদ-নদীর প্রবাহে মারাত্মক ক্ষতি করেছে ফারাক্কা।
নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন জানান, তাদের এক গবেষণায় দেখেছেন উজানে ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগের সময়ের তুলনায় এখন পদ্মার ৮০ শতাংশ পানির প্রবাহ কমে গেছে। কপোতাক্ষ, ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কুমার—যেগুলো সুন্দরবনে পানিপ্রবাহ নিয়ে যায় এ নদ-নদীগুলো আক্ষরিক অর্থে মরে গেছে। কপোতাক্ষ নদের কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও পানিই নেই। যে হাঁটু পানি দেখা যায় এটা বৃষ্টির পানি, গঙ্গা থেকে আর আসে না।
বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে নির্মিত ফারাক্কা ব্যারাজ প্রকল্পটির মূল লক্ষ্যই ছিল গঙ্গার প্রবাহ থেকে অতিরিক্ত পানি ভাগীরথীতে সরিয়ে আনা এবং তার মাধ্যমে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানো। তার জন্য কাটা হয়েছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটার লম্বা একটি ‘লিংক ক্যানাল’ বা কৃত্রিম খাল। তবে ভারতের অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, কলকাতা বন্দরকেও সেভাবে বাঁচাতে পারেনি ফারাক্কা বাঁধ। সে কারণে উপকূলের কাছে তৈরি করতে হয়েছিল আরেকটি স্যাটেলাইট বন্দর হলদিয়া।
এদিকে কয়েক বছর আগে ফারাক্কা ব্যারাজ ভেঙে দেয়ার দাবি তুলেছিল বিহার সরকারও। রাজ্যটির অভিযোগ, ফারাক্কার কারণে প্রতি বছর তাদের বন্যায় ভুবতে হয়। ফারাক্কার উজানে ও ভাটিতে গঙ্গার ভাঙনও ওই এলাকার মানুষের জন্য খুব বড় সমস্যা।
সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর : ড. আমানুর আমান,এম.ফিল (আইইউকে), পিএইচডি ( এনবিইউ- দার্জিলিং)
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শাহনাজ আমান।
কার্যালয়:- থানা ট্রাফিক মোড়, কুষ্টিয়া।মোবাইল- ০১৭১৩-৯১৪৫৭০, ইমেইল: info.dailykushtia@gmail.com
ই-পেপার কপি