দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
অবশেষে, বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত হয়ে গেল চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দরের । এটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ৭২ বছরের পুরোন প্রস্তাবিত একটি স্থলবন্দর। ১৯৫৩ সালের বন্দরটির যাত্রা শুরু হয়। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত বন্দরটি শুল্ক স্টেশন হিসেবে চালু ছিলো। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এটি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর শত কসরত করেও এটি আর চারু করা যায় নি।
বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরিষদের ৪০তম সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্তের মধ্যে মোট তিনটি বন্দর রয়েছে। বন্দরগুলো হলো—নীলফামারীর চিলাহাটি, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ এবং রাঙামাটির তেগামুখ স্থলবন্দর। এছাড়া হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা স্থলবন্দরের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হবে।
এর আগে গত ২ মার্চ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, অলাভজনক ও কার্যক্রমহীন তিনটি স্থলবন্দর সম্পূর্ণ বন্ধ এবং একটি স্থলবন্দরের কার্যক্রম স্থগিত রাখার সুপারিশ করেছে একটি যাচাই কমিটি। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে কমিটি এ প্রস্তাব দেয়।
উল্লেখ্য, গত বছর দেশের স্থলবন্দরগুলোর কার্যকারিতা যাচাই করতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। তারা আটটি স্থলবন্দর সরেজমিনে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করে, যার ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন পেল।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের গঠন করা একটি যাচাই কমিটি এ সুপারিশ করে।
সুপারিশে বলা হয় এ বন্দরগুলোর কার্যক্রম চালুর জন্য অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন নেই।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর পরিদর্শন করেন। এ সময়, বিগত সরকারের আমলে নির্মিত দেশের অলাভজনক ও কার্যক্রমহীন বিভিন্ন স্থলবন্দরসমূহের বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আটটি অলাভজনক ও কার্যক্রমহীন স্থলবন্দর কার্যকর/অকার্যকর-এর বিষয়ে যাচাইয়ের লক্ষ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
স্থলবন্দরগুলো পরিদর্শন শেষে প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে কমিটি।
ওই প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বাণিজ্য সম্ভাবনা বিবেচনায় নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার চিলাহাটি স্থলবন্দর, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর এবং রাঙ্গামাটির তেগামুখ স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালুর জন্য অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন নেই মর্মে সুপারিশ প্রদান করেছে। এ ছাড়া, হবিগঞ্জের বাল্লা স্থলবন্দরের কেদারকোটে নির্মিত স্থলবন্দরের ভারতীয় অংশে কোনো অবকাঠামো ও সড়ক না থাকায় বন্দরটির অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ রাখা যেতে পারে মর্মে সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ময়মনসিংহ জেলার গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের দুটি স্থানের পরিবর্তে একটি স্থানে স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু রাখার সুপারিশ করেছে কমিটি।
সুপারিশে বলা হয়েছে, শেরপুরের নাকুগাঁও স্থলবন্দর- কেন্দ্রিক গতিশীল অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলমান আছে। স্থলবন্দরটির কার্যক্রম আরও গতিশীল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। জামালপুরের ধানুয়া কামালপুর স্থলবন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং পূর্বে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম গতিশীল ছিলো এবং বন্দর-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম দৃশ্যমান। বিনিয়োগ বিবেচনায় ন্যূনতম জনবল দিয়ে এই বন্দরের কার্যক্রম চালু রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া, রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দরে বিদ্যমান ব্যবস্থায় রেল পথে আমদানি-রপ্তানি চালু রাখা যেতে পারে। ইমিগ্রেশন সুবিধা চালুর জন্য ভারতকে অনুরোধ করা যেতে পারে।
দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর/
স্থানীয়রা জানান, দৌলৎগঞ্জ স্থলবন্দর চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার দৌলৎগঞ্জ সীমান্তে অবস্থিত। আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার অন্তর্গত মাজদিয়া সীমান্ত এই বন্দরের বিপরীতে অবস্থিত। এই বন্দরের রুট দৌলৎগঞ্জ-মাজদিয়া সড়ক যোগাযোগ। দৌলৎগঞ্জ স্থলবন্দর থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব মাত্র ২৫৬ কিলোমিটার। উভয় দেশের সীমান্ত পর্যন্ত চওড়া পাকা রাস্তা রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর থেকে জীবননগর উপজেলায় এ বন্দরটির অবস্থান। জীবননগর থেকে ৪ কিঃ মিঃ দুরে এ প্রস্তাবিত দৌলৎগজ্ঞ-মাজদিয়া স্থলবন্দরে ।
বর্তমানে দৌলৎগঞ্জ-মাজদিয়া স্থলবন্দরের সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত সব সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে।
১৯৫৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দৌলতগঞ্জ-মাজদিয়া স্থলবন্দরটি শুল্ক স্টেশন হিসেবে চালু ছিলো। কিন্তু ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় শুল্ক স্টেশনটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১৯৭২ সালে শুল্ক স্টেশনটি ফের চালুর নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে আবারো এটি বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর ১৯৯৮ সালের ১৫ জুলাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আবার শুল্ক স্টেশনটি চালুর প্রজ্ঞাপন জারি করে বন্দরটিতে ১৯টি পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের ১১ জুন আরেকটি প্রজ্ঞাপনে শুল্ক স্টেশন কার্যকর করতে সংশ্লিষ্ট সব দফতরকে নির্দেশ দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। সেটাও আলোর মুখ দেখেনি।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এর আগে ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই জীবননগর দৌলতগঞ্জ শুল্ক স্টেশনটিকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছিলো। সে সময় একই বছর ২৪ আগস্ট তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী মোহাম্মদ শাজাহান খাঁন চালুর অপেক্ষায় থাকা এই বন্দরের ভিত্তিপ্রস্তরও উদ্বোধন করে গিয়েছিলেন। এরপর ২০১৪ সালের ৪ জুন তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী মোহাম্মদ শাজাহান খাঁন ও তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পংকজ শরন আবারো বন্দরের জন্য প্রস্তাবিত জায়গা পরিদর্শন করেন।
পরবর্তীতে ২০২৪ সালেরফেব্রুয়ারি মাসে চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগরের দৌলতগঞ্জকে স্থলবন্দর (স্থল কাস্টমস স্টেশন) হিসেবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক প্রজ্ঞাপনে এ ঘোষণা দেয়া হয়।
বন্দরে বর্তমানে তিন একর জমিতে ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড রয়েছে। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে ৫০ টন ধারণ ক্ষমতার ৩০ ফুট চওড়া রাস্তাসহ জীবননগর পর্যন্ত ২০ ফুট চওড়ার ৬ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। এছাড়াও বন্দর এলাকায় আরও ৪০ দশমিক ৪৮ একর জমি সহজলোভ্য দামে অধিগ্রহণ করা প্রক্রিয়াধীন ছিল।
এছাড়াও দৌলৎগঞ্জ-মাজদিয়া স্থলবন্দর সড়ক যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত সকল সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে। বন্দরটি থেকে ভারতের জাতীয় সড়কের দুরত্ব ৩৪ কিলোমিটার। তাছাড়া ভারতীয় অংশে টুঙ্গি থেকে কৃষ্ণনগর ৩৪নং জাতীয় মহাসড়ক থেকে সকল স্থানে যাতায়াত করা সম্ভব। জাতীয় সড়ক থেকে দেশের অন্যান্য স্থলবন্দরের যে দূরত্ব তার থেকে অনেক কম দুরত্ব অর্থাৎ ২৫ কিলোমিটার দৌলৎগঞ্জ-মাজদিয়া স্থলবন্দর। যার কারনে ভারতের সাথে দেশের অন্যান্য স্থলবন্দরের চেয়ে দ্রুত সময়ে পণ্য আমদানি এবং রপ্তানি ও পরিবহন খরচ অনেকাংশে সাশ্রয়ী করার সুযোগ ছিল।
অনেকেই আক্ষেপ করছেন বন্দরটির জন্য। চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ইয়াকুব হোসেন মালিক বলেন, বন্দরটি চালু হলে জেলার ব্যবসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতো। একেবারে বন্ধ করে দেয়ার ব্যাপারটি বোধগম্য নয় বলে তিনি জানান।
দৌলৎগঞ্জ-মাজদিয়া স্থলবন্দর বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি গোলাম মোর্তূজা জানান, এদেশে তো সব বন্ধই হয়ে যায়। চালুর উদ্যোগ কেউ নিতে চায় না।
আমরা সংগ্রাম করে আসছিলাম, সেটি থেমে গেল। এ অনচলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি চাকা বন্ধ হয়ে গেল।
সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর : ড. আমানুর আমান,এম.ফিল (আইইউকে), পিএইচডি ( এনবিইউ- দার্জিলিং)
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শাহনাজ আমান।
কার্যালয়:- থানা ট্রাফিক মোড়, কুষ্টিয়া।মোবাইল- ০১৭১৩-৯১৪৫৭০, ইমেইল: info.dailykushtia@gmail.com
ই-পেপার কপি