ড. আমানুর আমান, লেখক, গবেষক, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দি কুষ্টিয়া টাইমস
বাউল সঙ্গীতের এক জীবন্ত কিংবদন্তী ফরিদা পারভিন। এই নামটি লালন প্রেমীদের কাছে শুধু পরিচিতি নয়, লালন সঙ্গীতের মহা স্্েরাতধারায় এটি এক প্রেরণার উৎস। উপমহাদেশের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ভুবনে তার কণ্ঠ সুরের নদীর মতো বয়ে চলেছে যা শুধু গান নয়, বরং মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করা এক চিরন্তন বার্তা। তার গানে শুধু সুর নয়, বরং মানুষের হৃদয়কে জাগিয়ে দেওয়া এক ধরনের আলোকবর্ণের বার্তা নিহিত যা সহজ, সরল, অথচ গভীরভাবে অন্তরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। ফরিদার কন্ঠের মধ্য দিয়ে বাউল দর্শনের রস ভক্তদের মনের গভীরে যতোটা প্রবেশ করে প্রভাবিত করেছে, এতোটা কারো দ্বারা সংঘটিত হয়নি। ফরিদা পারভিন লালন সঙ্গীতকে শুধু শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেননি, বরং তাকে জীবন্ত, মানবিক ও চিরন্তন অভিজ্ঞতায় পরিণত করেছেন। ফরিদাকে এজন্য জীবন্ত লালন বললে অত্যুক্তি হয় না।
ফরিদার সঙ্গীতের মূল শক্তি হলো তার আন্তরিকতা। তার কণ্ঠে নেই কোনো ভাসা বা কৃত্রিম ছাপ; লালনের গানে ঠিক যেমনটি, ঠিক তেমনটিই ফরিদার গানের প্রতিটি নোটে শোনা যায় জীবনের গভীর অনুভূতি, প্রেমের উচ্ছ্বাস, ব্যথার চিৎকার এবং মানুষের সঙ্গে মানবতার এক অন্তর্ভুক্ত বন্ধন। তার গান মানুষের অস্তিত্ব, মানবিক সম্পর্ক, প্রেম ও সৌন্দর্যের সঙ্গে মিলিয়ে বাউল দর্শনের গভীর উপলব্ধি ঘটায়।
ফরিদা পারভীনের জীবন ও সঙ্গীত যাত্রা/
ফরিদা পারভীন জন্ম ও কৈশোর কুষ্টিয়ায় অতিবাহিত করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি গান ও শিল্পের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি শুরু করেছিলেন স্থানীয় গানের মাধ্যমে, কিন্তু শৈশব ও কৈশোরেই লালন ও বাউল গান তাঁর মনকে প্রভাবিত করে।
তারপরের জীবনকে চিহ্নিত করেছে বাউল সঙ্গীতের প্রতি অটল আনুগত্য। জীবনানন্দ এবং লালনের দর্শনের সংমিশ্রণে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব কণ্ঠস্বর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন আবু জাফরের স্ত্রী এবং পরবর্তীতে বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিমের সহধর্মিণী। এই পারিবারিক জটিলতা ও জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে তিনি তাঁর গানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
বাউলের আলোয় আলোকিত মন/
বাউল সঙ্গীতের আলোকে যে ক’জন শিল্পী বাংলা সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে নতুন পরিচয় দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ফরিদা পারভীনের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হবে। লালনের গানে যে মানবিক চেতনা, যে সাম্যের বার্তা ও যে সহজ অথচ গভীর দর্শন নিহিত, তা তিনি নিজের কণ্ঠে রূপ দিয়েছেন সুরের নদীতে। সেই সুর শুধু শ্রোতার কানে পৌঁছায়নি, পৌঁছেছে মনের গভীরে। তাই ফরিদা পারভীন কেবল একজন শিল্পী নন, তিনি এক আলোকবর্তিকা, যিনি বাউলের আলোয় মানুষের হৃদয়কে জাগিয়ে দিয়েছেন।
লালন থেকে জীবন্ত লালন/
অনেকে তাঁকে অভিহিত করেন জীবন্ত লালন নামে। এতে কোনো অতিরঞ্জন নেই। কারণ লালন শাহ যেমন তাঁর সময়ে সমাজকে প্রশ্ন করেছেন, বিভেদ ভেঙে মানবতার ডাক দিয়েছেন, ফরিদা পারভীনও তাঁর গানে সেই মানবতাবাদী সুরকে জীবন্ত রেখেছেন। তাঁর কণ্ঠে লালনের গান হয়ে উঠেছে এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা যেখানে প্রেম আছে, ব্যথা আছে, আবার মুক্তিরও ইঙ্গিত আছে। ফরিদা পারভিন শুধুমাত্র একজন শিল্পী নন; তিনি বাউলধর্ম, মানবিকতা, সহমর্মিতা ও প্রেমের জীবন্ত প্রতিনিধি। তার সঙ্গীত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাউল কেবল সঙ্গীত নয়, এটি জীবনদর্শন, যা মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে। তার কণ্ঠে রয়েছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিক সাধনা এবং মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা—সবকিছু একসাথে মিশে এক অনন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।
আন্তরিকতার শক্তি/
ফরিদার গানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর আন্তরিকতা। তাঁর কণ্ঠে নেই কোনো অভিনয় বা ভাসা ছাপ; নেই কোনো কৃত্রিম সৌন্দর্য নির্মাণের প্রয়াস। প্রতিটি সুর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি উচ্চারণে ছিল জীবনের গভীর অনুভব। প্রেমের উচ্ছ্বাস, দুঃখের আর্তনাদ, মানুষের সঙ্গে মানুষের অন্তর্ভুক্ত বন্ধন—সবই মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত তাঁর গানে। ফলে শ্রোতা শুধু গান শুনতেন না, বরং গান হয়ে উঠত এক আত্ম-অন্বেষার অভিজ্ঞতা।
যখন ফরিদার কণ্ঠে ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ বাজে, তখন মনে হয় তিনি শুধু গান করছেন না, বরং জীবন ও মানবিকতাকে অভিসিক্ত করছেন। তার সঙ্গীতের প্রতিটি নোটে আছে মানবতার স্পন্দন, প্রেমের আহ্বান এবং অন্তরের মুক্তির তৃষ্ণা। ফরিদা পারভিন একাধারে বাউল সাধক, দার্শনিক ও মানবিকতার দূত। তার সুরগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই জীবন কেবল জীবনের জন্য নয়, বরং একে আরেকজন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার প্রতিফলন করাই মূল লক্ষ্য।
বাউল দর্শনের আলো/
বাউল গান কেবল সুরেলা বিনোদন নয়; এটি এক জীবনদর্শন। মানুষের ভেতরকার মানুষকে চিনে নেওয়ার সাধনা। ফরিদা পারভীন তাঁর কণ্ঠের মাধ্যমে সেই দর্শনকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর গানে পাওয়া যায় অস্তিত্বের খোঁজ, মানবিক সম্পর্কের গভীরতা, প্রেম ও সৌন্দর্যের এক চিরন্তন আবেদন। এভাবেই তিনি লালনকে তুলে ধরেছেন কেবল সংগীতরসিকদের কাছে নয়, সাধারণ মানুষেরও অন্তরে। বাউল দর্শন প্রথাগত ধর্ম, বর্ণ বা সামাজিক বিভাজনকে অতিক্রম করে মানবিক চেতনার ওপর জোর দেয়। ফরিদা পারভীনের কণ্ঠ এই দর্শনকে আধুনিক সমাজে বহন করেছে। আজকের বাংলাদেশের সমাজে, যেখানে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক বিভাজন বিদ্যমান, ফরিদার গান মানুষের মধ্যে এক ধরণের মানবিক সংযোগ স্থাপন করেছে। তিনি বাউল দর্শনের মূল ভাবকে সংক্ষিপ্তভাবে প্রদর্শন করেছেন—মানবতা, প্রেম এবং আত্মজ্ঞান।
অন্যান্য বাউল শিল্পী:
ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের দর্শনের মানবিকতা সর্বোচ্চ সরলতা ও গভীরতার সঙ্গে সমৃদ্ধ। অন্যান্য শিল্পী যেমন গান পরিবেশন করেছেন, তিনি তা শ্রোতার হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছেন জীবন্ত অভিজ্ঞতায়।
সংস্কৃতির সম্পদ/
ফরিদা পারভীন শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের সাংস্কৃতিক সম্পদ। তাঁর গানে মিশে ছিল বাংলার মাটি, মানুষের দুঃখ–সুখ, ইতিহাস আর স্বপ্ন। তিনি আমাদের শোনাতেন না শুধু একটি গান, বরং একটি দর্শন, একটি জীবনবোধ, একটি আলো।
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে গাওয়া লালনের গান আজও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। তাঁর গান শুনলেই মনে হয়—মানুষ আসলে কেবল দেহের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, সে এক অন্তহীন আলোর খোঁজে চলমান প্রাণী। ফরিদা পারভীনের গান সেই আলোর খোঁজকে সহজ করেছে, কাছে এনেছে।
লেখক: ড. আমানুর আমান, লেখক ও গবেষক, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দি কুষ্টিয়া টাইমস
সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর : ড. আমানুর আমান,এম.ফিল (আইইউকে), পিএইচডি ( এনবিইউ- দার্জিলিং)
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শাহনাজ আমান।
কার্যালয়:- থানা ট্রাফিক মোড়, কুষ্টিয়া।মোবাইল- ০১৭১৩-৯১৪৫৭০, ইমেইল: info.dailykushtia@gmail.com
ই-পেপার কপি