
মিথোস আমান, নির্বাহী সম্পাদক, দি কুষ্টিয়া টাইমস/
আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম সংযোজিত হয়েছিল বিশ্বমানচিত্রে। একাত্তরের এই দিনে বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য। সগৌরবে উত্তোলিত হয়েছিল একটি লাল-সবুজ পতাকা। লাখো কণ্ঠ গেয় উঠেছিল ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি...।’
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সকল অধ্যায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল অর্জন। মুক্তিযদ্ধের এ অর্জনের মধ্য দিয়েই আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এই স্বাধীনতা কোনো দান নয়; এটি অর্জিত হয়েছে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ ও প্রায় দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ফলই আমাদের স্বাধীনতা। দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও অদম্য সংগ্রামী চেতনার সঙ্গে এই অর্জন গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি/
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর একটি দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়। জাতি পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামক দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে যেখানে পশ্চিম পাকিস্তান শাসকে পরিণত হয় আর পূর্ব পাকিস্তান’ পরিণত হয় শোষিতে। অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের মাধ্যমে এ ভূখণ্ডকে শোষণের উপনিবেশে পরিণত করে। প্রথম আঘাত আসে ভাষার উপর। ঐ গোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। শুরু হয় প্রতিবাদ। প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররা জীবন উৎসর্গ করে। শহীদদের রক্তে সঞ্জীবিত এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালীর অবিসংবিদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করলেও শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়, ফলে সারা দেশে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে।
স্বাধীনতার ঘোষণা ও যুদ্ধের সূচনা
ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানায় পরিস্থিতি চরমে পৌঁছালে ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্য প্রত্যাবর্তন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান এবং বিকল্প হিসেবে ঘোষণা করেন—“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ভাষণ জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ করে এবং স্বাধীনতার স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয় যেটা ইউনেস্কো বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
৭ই মার্চের ভাষণের পর বাঙালির মুক্তি আকাঙ্ক্ষা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। ২৪শে মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক ব্যর্থ হলে ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম গণহত্যা চালায়। ওই রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের ঠিক আগমুহূর্তে, ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রচারিত হয় এবং চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান ২৬শে মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতার থেকে তা প্রচার করেন। পরদিন ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে, যোদ্ধাদের মনোবল জাগ্রত করে এবং মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা করে।
সরকার গঠন, বৈদেশিক সহযোগিতা ও বিজয়/
১০ই এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে। দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। পাকবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ কূটনৈতিক ও মানবিক সহায়তা দেয়।
পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও চূড়ান্ত বিজয়/
১৪ই ডিসেম্বর যৌথবাহিনী ঢাকার নিকটবর্তী হলে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ. কে. নিয়াজী ৯৩ হাজার সৈন্যসহ যৌথ কমান্ডারের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়।
উপসংহার/
লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে আমরা পেয়েছি এক স্বাধীন ভূখণ্ড—যা শুধু ভৌগোলিক সীমানা নয়, বরং স্বপ্ন, সাহস, ঐক্য এবং মানবতার অমূল্য উত্তরাধিকার। আজকের প্রজন্মের পবিত্র কর্তব্য এই চেতনাকে জাগরূক রাখা, শহীদদের আত্মত্যাগকে সম্মান করা এবং দেশকে আরও সমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক করে গড়ে তোলা। এই বিজয় আমাদের শিক্ষা দেয়: ঐক্যবদ্ধ হলে কোনো অত্যাচারী শক্তিই অজেয় নয়।
উদযাপন/
জাতি আজ পরম শ্রদ্ধা আর গভীর কৃতজ্ঞতার মধ্য দিয়ে স্মরণ করবে দেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন উৎসর্গ করা বীর সন্তানদের। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদি ভরে উঠবে অগণিত মানুষের নিবেদিত শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং ঐক্যের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।’
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এবারের বিজয় দিবস হোক জাতীয় জীবনে নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে যে নবযাত্রা সূচিত হয়েছে তা যে কোনো মূল্যে রক্ষার শপথ নেওয়ার দিন।’
দিবসটি উপলক্ষে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন, সড়কদ্বীপ ও স্থাপনা আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ।
দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হয়েছে।
আজ সরকারি ছুটি। রাজধানীর পাড়ামহল্লা, সড়কের মোড়ে মোড়ে বাজবে মুক্তির অবিস্মরণীয় গান। বাড়ির ছাদের কার্নিশে, অফিস-আদালত, দোকানপাটে, অনেক যানবাহনে উড়বে লাল-সবুজ পতাকা। আজ ভোরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রাণ দেওয়া শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন।
সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকর : ড. আমানুর আমান,এম.ফিল (আইইউকে), পিএইচডি ( এনবিইউ- দার্জিলিং)
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: শাহনাজ আমান।
কার্যালয়:- থানা ট্রাফিক মোড়, কুষ্টিয়া।মোবাইল- ০১৭১৩-৯১৪৫৭০, ইমেইল: info.dailykushtia@gmail.com
ই-পেপার কপি