November 21, 2024, 12:26 pm
ড. আমানুর আমান, সম্পাদক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দি কুষ্টিয়া টাইমস/
আজ ১৭ এপ্রিল ; ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির এক অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে নির্বাচিত ১৬৭ জন এমএনএ ও ২৯৩ জন সংসদ সদস্য মিলিত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। তাদের যোগ্য নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় এই দিনে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং এই সরকারের ঘোষণা ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করে যা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বৈধ প্রাণপ্রবাহ এনে দিয়েছিল।
এই সরকার গঠনের ফলে বিশ্বজুড়ে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামরত বাঙালিদের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত হয়। এই সরকার থেকেই অতি দ্রæততার সাথে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জাতীয়-আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় এবং বাংলাদেশের জনগণকে তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্পবী কার্যক্রমের মাধ্যমে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অদম্য স্পৃহায় মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয় এবং সেদিন যুদ্ধরত জনগনের মাঝে একটি যুদ্ধ জয়ের বাসনা ছড়িয়ে দিতে এই সরকার পুরোপুরি সমর্থ হয়েছিল।
প্রেক্ষপট/
ইতিহাসের একটি স্পষ্ট রেখা ধরে মুজিবনগর সরকারের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। সকল সংগ্রাম, প্রত্যাশা প্রভৃতি স্তরগুলো যখন একটি পরিণত অবস্থার দিকে ঘটনার প্রবাহগুলোকে নিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনই মুক্তির সকল ম্যান্ডেট দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞে নেমে পড়ে বাংলার ওপর ; তৈরি হয় ১৯৭১’র ভয়াল ২৫ মার্চ। বন্দি করা হয় স্বাধীনতার মূল প্রতীক বঙ্গবন্ধুকে। দেশজুড়ে শুরু হয় স্বাধীনতাকামী জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ, মুক্তির যুদ্ধ। কিন্তু এ যুদ্ধের বৈধতা প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা, অস্ত্র সুরক্ষা ও প্রশিক্ষণ। প্রয়োজন ছিল কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করা।
শুরু হয় একটি সরকার গঠনের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা। আলোচনার অন্যতম একটি সিদ্ধান্ত ছিল কোথায় কিভাবে এ সরকার গঠন ও তা ঘোষিত হবে। দেশ তখন যুদ্ধরত। একটি যুদ্ধরত বাংলা ভূখন্ডে একটি বৈধ স্বাধীন সরকার গঠন করতে প্রয়োজন ছিল একটি মুক্তাঞ্চল। এ লক্ষ্যে তৎকালীন কুষ্টিয়া অঞ্চলকে ঘিরে শুরু হয় পরিকল্পনা।
কুষ্টিয়ার মাটিতেই ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। ওই দিন কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ মাঠে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় লাল সবুজের ছয়টি তারা খচিত একটি পতাকা স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসাবে উড়িয়ে দেয়া হয়। ২৩ মার্চ কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে পুনরায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়া ছিল ৮ নং সেক্টরের অধীনে। যশোর, কুষ্টিয়া জেলা, দৌলতপুর, সাতক্ষীরা সড়ক পর্যন্ত খুলনা জেলা এবং ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে এই সেক্টর গঠিত। সাতটি সাব-সেক্টর নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল কল্যাণীতে। এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (পরবর্তীকালে লে. কর্নেল ) এবং পরে আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মেজর এম এ মঞ্জুর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর পদে কুষ্টিয়ায় কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে ২৬ মার্চ তিনি কুষ্টিয়ার চুয়াডাঙার ঘাঁটিতে পৌঁছে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং সেখানেই অবস্থান করেন। সেখানে পৌঁছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, পদ্মা-মেঘনার পশ্চিমাঞ্চলকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন নামকরণ করে নিজেকে অধিনায়ক ঘোষণা করেন। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের দেয়া নকশার উপর ভিত্তি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী কুষ্টিয়ার মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত জয় বাংলা বাহিনী নিয়ে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর সাথে প্রথম সন্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন ৩০ মার্চ।
১ এপ্রিল বাংলাদেশের মধ্যে কুষ্টিয়া প্রথম শক্রমুক্ত হয়। বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র কুষ্টিয়া জেলা ১৬ দিন শত্রুমুক্ত থাকে। আর এই ১৬ দিনই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের রক্তস্নাত পথে এক সঞ্জীবনির মতো। স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাকিস্থানের অন্ধকার কারাগারে বন্দি, যখন পাকিস্থান বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্বের কাছে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে দেখাতে মরিয়া তখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী নেতারা একটি স্বাধীনতার ইশতেহার তৈরি করেন। সেই ইশতেহার ঘোষণার জন্য বাংলাদেশের ভূমিতে খুব প্রয়োজন ছিল একটি মুক্তাঞ্চল। প্রতিরোধ যুদ্ধে ‘স্বাধীন’ হওয়া সেদিনের কুষ্টিয়াঞ্চল ছিল সেই ভুমি, কুষ্টিয়ার অন্যতম মহকুমা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা (বর্তমান মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলা)। সেখানে দাঁড়িয়েই সেদিন ঘোষিত হয় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। যে সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।
জীবিত থাকাকালীন সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কুষ্টিয়াই একমাত্র জেলা যেটা শত্রুমুক্ত হয় যুদ্ধের প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যেই। এর ধারাবাহিকতায় আমরা মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণের জন্য মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে এবং সেই এলাকা প্রস্তুত করতে পেরেছিলাম।’
সেদিন যে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছিল তা খুবই কঠিন কাজ ছিল। বিশ্ব সম্প্রদায়ই সেদিন এরকমই আখ্যা দিয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের তাৎপর্য যে কত সুদূরপ্রসারী প্রভাব সৃষ্টি করেছিল মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। তিনি মুজিবনগরকে ফিলাডেলফিয়ার সাথে তুলনা করেন, যেখানে আমেরিকান স্বাধীনতার ঘোষণা গৃহীত হয়েছিল। এ সরকার গঠনের পেক্ষাপট তাই সেদিন বিদেশি সাংবাদিক, কূটনীতিকদের আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। মুজিবনগর সরকার সেদিন এক পরিশীলিত সমন্বয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামীর মনোবল অবচেতন পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিল। সেদিন যদি এটি গঠন করা না হতো তাহলে দেশুজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া জনযুদ্ধ ও আন্দোলনগুলি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যেত না এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এতো বেগবান করা যেতো না।
Leave a Reply