September 10, 2025, 5:34 am
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ (টঝঈওজঋ)। জুলাই মাসে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিশদ রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনি অস্পষ্টতা ও সামাজিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ধর্মীয় সহনশীলতা মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে।
ঢাকায় সফরের ভিত্তিতে রিপোর্ট/
২০২৫ সালের মে মাসে ঢাকায় ইউএসসিআইআরএফ-এর একটি প্রতিনিধিদল উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রিপোর্টটি প্রণয়ন করে। রিপোর্টের মূল লেখক সীমা হাসান, সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা/
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং আগস্টে সেনাবাহিনীর সমর্থনে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই রাজনৈতিক রদবদলের সময়, বিশেষ করে ৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রশাসনিক শূন্যতার ফলে ভয়াবহ সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলার ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়, এসব হামলার পেছনে ‘আওয়ামী লীগ-ঘনিষ্ঠ’ পরিচয়ভিত্তিক প্রতিহিংসা কাজ করেছে।
পুলিশি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বলা হয়, ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশে মোট ১,৭৬৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ১,২৩৪টি রাজনৈতিক, ২০টি সাম্প্রদায়িক এবং ১৬১টি ভিত্তিহীন অভিযোগের ভিত্তিতে সংঘটিত। এ সময় কিছু মুসলিম নাগরিক ও শিক্ষার্থী সংখ্যালঘুদের ব্যবসা ও উপাসনালয় পাহারা দিয়ে সংহতির বার্তা দেন।
সংবিধান সংস্কারে বিতর্ক/
অন্তর্র্বতী সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়েও রিপোর্টে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। কমিশন প্রস্তাব করেছে সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ বা ‘বহুত্ববাদ’ অন্তর্ভুক্ত করার। এই প্রস্তাব বিএনপি প্রত্যাখ্যান করে প্রস্তাব করে—‘আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা’ শব্দবন্ধ সংযুক্ত করা হোক। জামায়াতে ইসলামি ও শিক্ষার্থীদের গড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আংশিক সমর্থন জানিয়ে ‘বহুত্ববাদ’ শব্দের পরিবর্তে বাংলা বিকল্প ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ ব্যবহারের পক্ষে মত দেয়।
নারী কমিশনের সুপারিশ ও ইসলামপন্থীদের প্রতিক্রিয়া/
নারী সংস্কার কমিশনের দেওয়া ৪৩৩টি সুপারিশের মধ্যে অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক আইন প্রণয়ন, যা ধর্মীয় পারিবারিক আইনকে সম্পূরক হিসেবে কাজ করবে। এই প্রস্তাবের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম বিক্ষোভ করে, কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে কটূক্তি করে এবং তাদের ‘ইসলামবিরোধী’ আখ্যা দেয়। নারীদের নিয়ে কটূক্তির ঘটনায় ছয়জন নারী হেফাজতের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ দিলে সংগঠনটি পরে ক্ষমা চায়। এছাড়া, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একটি নারী ফুটবল ম্যাচ বাতিল করতে বাধ্য করে এবং নারী অধ্যাপক নাদিরা ইয়াসমিনকে হুমকির মুখে অন্য কলেজে বদলি হতে হয়
আইনি ধারা ও সাইবার আইন নিয়েও উদ্বেগ/
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে এখনো দণ্ডবিধির ১৯৫এ ধারা বলবৎ রয়েছে, যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা ফৌজদারি অপরাধ। এছাড়া, ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন ডিজিটাল কনটেন্ট প্রকাশের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এই আইনকেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইউএসসিআইআরএফ।
ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগ ও পরামর্শ/
সংস্থাটির মতে, সংবিধান সংস্কারে সংখ্যালঘুদের মত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে, ধর্মীয় সহনশীলতা আরও হুমকির মুখে পড়বে। দীর্ঘমেয়াদে তা বৈষম্য আরও গভীর করতে পারে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষায় বাংলাদেশকে একটি নতুন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক স্তরে সক্রিয় অংশগ্রহণই দীর্ঘস্থায়ী শান্তির মূল চাবিকাঠি হতে পারে।