November 14, 2025, 3:35 am

শুভব্রত আমান, কুষ্টিয়া/
রাজশাহীর বাঘা, নাটোরের লালপুর ও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর পদ্মা নদীর এই তিন উপজেলার চরে এখন এক নামেই ভীত-সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ: ‘কাকন বাহিনী’।
বালুমহাল ও জমি দখল, চাঁদাবাজি, অস্ত্রের মহড়া ও খুন-গুম—সব কিছুরই অভিযোগ উঠেছে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে। সর্বশেষ জমি দখলকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ডাবল মার্ডারের ঘটনায় আবারও আলোচনায় এসেছে কাকন বাহিনীর নাম।
গত সোমবার (২৭ অক্টোবর) সকালে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খানপুর পদ্মা চরে জমি ও খড় দখল নিয়ে কাকন বাহিনীর সদস্যরা মনতাজ মণ্ডল গ্রুপের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়।
চোখের পলকে নদীপথে পিচবোর্ডে ভেসে আসা ১০-১৫ জনের দলটি এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। এতে চারজন গুলিবিদ্ধ হন আমান মন্ডল ও নাজমুল হক ঘটনাস্থলেই মারা যান, আহত হন মুনতাজ ও রাকিব।
গুলির শব্দে প্রথমে স্থানীয়রা আতঙ্কে পালিয়ে যায়। পরে গ্রামবাসী ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের উদ্ধার করে বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেন। সেখানেই রক্তক্ষরণে মারা যান আমান মন্ডল। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পথে প্রাণ হারান নাজমুল হক।
এ ঘটনায় মোট নিহত হন চারজন। গত পরশু দুপুরে সর্বশেষ একজনের লাশ করা হয় পদ্মা নদী থেকে।
মানববন্ধনে বিচার দাবি/
এ ঘটনায় নিহত আমান মন্ডলের পিতা মিনহাজ মন্ডল বুধবার বিকেলে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানায় কাকনকে প্রধান আসামি করে ২৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
পরদিন শুক্রবার দুপুরে খানপুর বাজারে নিহতদের পরিবার ও এলাকাবাসী মানববন্ধন করে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান।
মানববন্ধনে মিনহাজ মণ্ডল বলেন, “কাকন বাহিনী ও তাদের লোকজন প্রকাশ্যে নদীপথে পিচবোর্ডে চড়ে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করছে, জমি দখল করছে। আমরা এই হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচার চাই।”
নিহতদের পরিবারের সদস্য আসমা বেগম ও শারমিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমরা কোনো রাজনীতি জানি না। শুধু স্বামীর হত্যার বিচার চাই। কাকন বাহিনীকে গ্রেফতার করুন।”
পুরোনো আতঙ্ক : ফসল লুট থেকে গুলিবর্ষণ/
স্থানীয় বাসিন্দা মাহাবুল আলম জানান, কাকন বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে পদ্মা চরের জমি দখল, ফসল লুট ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। গত বছর এই বাহিনীর গুলিতে খানপুর গ্রামের সাহাবুল ইসলাম গুরুতর আহত হন এবং তাকে ঢাকায় চিকিৎসা নিতে হয়।
তিনি বলেন, “এখন রাজশাহীর বাঘা, নাটোরের লালপুর আর কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মানুষ একটাই আতঙ্কে দিন কাটায়—কাকন বাহিনী কবে কোথায় হামলা চালাবে!”
কাকনের উত্থান : সৌদি ফেরত থেকে সন্ত্রাসী ডন/
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কাকনের প্রকৃত নাম কাকন উদ্দিন। তার আদি বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়চা গ্রামে।
তার বাবা মৃত জমির উদ্দিন স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের একজন সহকারী ছিলেন।
কাকন ১৯৯৪ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেন এবং কিছুদিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ২০০৭ সালে তিনি সৌদি আরবে পাড়ি জমান। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে এসে স্থানীয় রাজনীতিকদের ছত্রচ্ছায়ায় পদ্মা নদীর বালুমহাল নিয়ন্ত্রণে জড়ান। এখান থেকেই তিনি গড়ে তোলেন কুখ্যাত ‘কাকন বাহিনী’।
বর্তমানে বাহিনীটির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪০ জন, যারা নিয়মিত সশস্ত্র অবস্থায় নদীচরে টহল দেয় বলে স্থানীয়রা জানান।
বাঘা থানা সূত্র জানায়, “কাকন বাহিনীকে ধরতে একাধিকবার অভিযান চালানো হলেও এখনো কাকনের অবস্থান জানা যায়নি।
অন্যদিকে দৌলতপুর থানার ওসি সোলায়মান শেখ বলেন, “কাকন বাহিনীর সদস্যরা মাঝেমধ্যেই এলাকায় গুলিবর্ষণ ও মহড়া দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। গত ৫ জুন তারা ঈশ্বরদী উপজেলার সাড়াঘাটে বালুমহাল দখল নিতে ফিল্মি স্টাইলে গুলিবর্ষণ করেছিল। সর্বশেষ বাঘায় চারজনকে গুলি করেছে—এর মধ্যে দু’জন মারা গেছে। মামলার পর আমরা তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।”
চরজুড়ে আতঙ্ক, মানুষ চাইছে শান্তি/
পদ্মা চরের বিস্তীর্ণ এলাকায় এখন রাতেও জেগে থাকে মানুষ। গ্রামবাসীর ভাষায়, “দিনে কাজ করতে ভয়, রাতে ঘুমাতে ভয়।”
কাকন বাহিনীর ভয়াবহ প্রভাব তিন জেলার সীমান্তজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা প্রশাসনের কাছে দ্রুত ‘চরনিরাপত্তা জোন’ ঘোষণা ও বিশেষ অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছেন। চরবাসীর আশা—আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অভিযানেই যেন শেষ হয় ‘কাকন বাহিনীর’ দুঃশাসন, আর ফিরে আসে বহু প্রতীক্ষিত শান্তি।