December 31, 2025, 9:09 pm

দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশ-ইনের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) অভিযোগ অনুযায়ী তাদের অভিযান সরিয়ে নিয়েছে চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা সীমান্তে। সেখান দিয়ে একই ১৪ জনের ভারতীয় পরিবারকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। পুরুষ, নারী, শিশু ও বয়স্ক সদস্যদের নিয়ে গঠিত এই পরিবারটি শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) ভোরের দিকে দর্শনা সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
স্থানীয় সূত্র ও ভুক্তভোগীদের বরাতে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে (২৫ ডিসেম্বর) বিএসএফ সদস্যরা দর্শনা নিমতলা সীমান্ত এলাকার কাঁটাতারের বেড়ার একটি গেট খুলে তাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেন।
প্রচণ্ড শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে প্রথমে আশ্রয় নেয় পরিবারটি, পরে দর্শনার বাস টার্মিনালের কাছাকাছি থাকেন। দিনের বেলায় ঘটনাটি তেমন নজরে না এলেও সন্ধ্যার দিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের নজরে আসে। মানবিক কারণে তারা অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন এবং খাবার ও শীতবস্ত্র দেন।
সাংবাদিকদের আগমন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সক্রিয় হয়।
কুষ্টিয়ায় ব্যর্থ পুশ-ইন ও পতাকা বৈঠক
বিজিবি সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর সীমান্ত দিয়ে একই ১৪ জন ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে বিএসএফ। কিন্তু বিজিবি-৪৭ ব্যাটালিয়নের কঠোর টহল ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুই বাহিনীর মধ্যে কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কুষ্টিয়া ব্যাটালিয়নের মহিষকুন্ডি বিওপির সুবেদার আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের বিজিবি প্রতিনিধিদল এবং ১৪৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের নিউ উদয় কোম্পানির কমান্ডার এসি অনিল কুমারের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের বিএসএফ দল বৈঠকে অংশ নেয়।
বৈঠকটি বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিট থেকে ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ভারতীয় অভ্যন্তরে মেইন পিলার ১৫৪/০৭-এস সংলগ্ন চাইদোয়াবা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে বিজিবি পুশ-ইনের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পরিচয় ও ঠিকানা যাচাইয়ের পর নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তারা সবাই ভারতের ওড়িশা রাজ্যের নাগরিক। এরপর বিএসএফ তাদের ভারতীয় ভূখণ্ডে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
ওড়িশার বাসিন্দা, তবু ‘বাংলাদেশি’ তকমা/
ভুক্তভোগীরা জানান, তারা ওড়িশার জগৎসিংহপুর জেলার জগেশ্বরপুর/তারিকুন্ডা এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। সবাই মুসলিম। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ভারতীয় পুলিশ ও বিএসএফ তাদের হয়রানি করে, আধার কার্ড ও রেশন কার্ড কেড়ে নেয় এবং ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে সীমান্ত পার করে দেয়।
পরিবারের সদস্য শেখ আব্দুর জব্বার (৭০/৭৩) বলেন, তারা প্রায় ৭০ বছর ধরে ওড়িশায় বসবাস করছেন। সেখানেই তাদের জন্ম, বিয়ে, পারিবারিক জীবন—সবকিছু গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের কোনো জেলায় তাদের স্থায়ী ঠিকানা নেই বলে তারা জানেন না।
তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, প্রায় এক মাস আগে রাতে স্থানীয় পুলিশ তাদের আটক করে। অটগড় জেলে এক মাস পাঁচ দিন থাকার পর বুধবার সন্ধ্যায় মুক্তি পান। মুক্তির কয়েক ঘণ্টা পর, ভোররাত আনুমানিক ৩টার দিকে বিএসএফ তাদের কুষ্টিয়া সীমান্তে নিয়ে কাঁটাতারের গেট খুলে মাঝরাতে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়।
চুয়াডাঙ্গায় নতুন অনুপ্রবেশ, প্রশাসনের সাড়া/
কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একই পরিবার চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ফের বাংলাদেশে উপস্থিত হওয়ায় সীমান্ত ব্যবস্থাপনা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।
তথ্য পেয়ে শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশ ও বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের উদ্ধার করে। কয়েকজন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
দর্শনা থানার ওসি মেহেদী হাসান জানান, অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে রয়েছেন শেখ জব্বার, তাঁর ছেলেরা শেখ হাকিম, শেখ ওকিল, শেখ রাজা ও শেখ বন্তি; তাদের স্ত্রীসহ অন্যান্য নারী সদস্য এবং চারটি শিশু। অনেকেরই শারীরিক অসুস্থতা রয়েছে।
“প্রথমে চিকিৎসা নিশ্চিত করা হচ্ছে। পরে জেলা প্রশাসন ও দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে,” বলেন ওসি।
একই পরিবার কুষ্টিয়ায় ব্যর্থ হয়েও কীভাবে চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ঢুকল—এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিজিবি ও প্রশাসনের দ্রুত সাড়া প্রশংসিত হলেও সীমান্ত নজরদারি ও সমন্বয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নির্বাচনকালীন সংবেদনশীলতার কথা মাথায় রেখে স্থানীয়রা ভবিষ্যতে এ ধরনের পুশ-ইন ঠেকাতে আরও কঠোর সীমান্ত নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক সতর্কতা দাবি করেছেন।
এ প্রতিনিধি চুয়াডাঙ্গা বিজিবি-৬ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজমুল হাসানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সম্ভব হয়নি।