April 19, 2025, 9:22 pm
ড. আমানুর আমান, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কুষ্টিয়া/
বাংলার যত উৎসব, অনুষ্ঠান ও পালা-পার্বণ আছে, তার মধ্যে পহেলা বৈশাখ—বাংলা নববর্ষ—একটি স্বতন্ত্র, খাঁটি এবং প্রকৃত অর্থেই বাঙালির উৎসব।
এই উৎসবটি বাংলার চিরন্তন ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে—একটি পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ উৎসব, যা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ৩০ কোটিরও বেশি বাঙালির প্রাণে রক্তের মতো প্রবাহিত। এটি একমাত্র উৎসব, যা বাঙালির আত্মার প্রতিটি দিক—আনন্দ ও বেদনা, আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা ও স্বপ্ন, ইচ্ছা ও হতাশা, খাদ্যাভ্যাস—সবকিছুরই প্রতিচ্ছবি। এটি মূলত বাঙালি পরিচয়ের এক নির্মল ও গর্বিত উৎসব—যার শিকড় ঐতিহ্যে গভীরভাবে প্রোথিত।
এই দিনে গান, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র, পোশাক এবং খাবারের মাধ্যমে বাঙালি নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করে, নবায়ন করে। পহেলা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতি। এটি আমাদের সভ্যতা—সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্মীয় গণ্ডির ঊর্ধ্বে—এবং পৃথিবীর কাছে আমাদের একতাবদ্ধ মানবিক চেতনার গর্বিত প্রকাশ।
পৃথিবীর খুব কম জাতিগোষ্ঠীই তাদের নিজস্ব নববর্ষ উদযাপন করে। বাঙালিরা সেই গর্বিত জাতিগুলোর একটি—যাদের আছে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি, নিজস্ব ভাষা, শক্তিশালী লিপি, ছয়টি স্বতন্ত্র ঋতু এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। পৃথিবীর আর কোনো জাতি এই ছয় ঋতুকে এত আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করে না। বাংলার বাইরেও এমন ঋতুবৈচিত্র্য আর কোথাও নেই—এটিও আমাদের গৌরবের অংশ।
এই ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিমূলক উৎসবে, সীমাহীন আনন্দের মধ্য দিয়ে, বাঙালি খুঁজে পায় তার প্রকৃত পরিচয়। চৈত্রে রবি ফসলের ঘরে ওঠা, বৈশাখে বোরো ধান, জ্যৈষ্ঠে পাকা আম-কাঁঠাল, আষাঢ়-শ্রাবণের ঘন বর্ষণ, শরতে কাশফুলের হাওয়া, অগ্রহায়ণে নবান্ন, পৌষে পিঠে-পুলি আর মাঘে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা—এসবই চিরায়ত গ্রামীণ জীবনের অনবদ্য নিদর্শন।
উইকিপিডিয়ার মতে, বৈশাখ মাসের নাম এসেছে বিষাখা নক্ষত্র থেকে। গ্রীষ্মকালে এই বিষাখা ছড়িয়ে পড়ে বাংলার ভূমি, নদী ও অরণ্যে—জ্বালায় আগুনের আঁচ। তবুও, বৈশাখের আগমন বয়ে আনে সৌন্দর্য, আশা ও প্রেরণা। প্রকৃতি যতই তাপদগ্ধ হোক না কেন, বাংলার কোমল মাটির স্নিগ্ধতায় সে সিক্ত থাকে। বৈশাখ নতুন শক্তি জোগায়, পুরাতনকে ধুয়ে-মুছে নবীনকে বরণ করে নেওয়ার প্রেরণা দেয়।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে নববর্ষ/
আজ এই উৎসব দেশকাল পেরিয়ে আরও বিস্তৃত হয়েছে। এটি এখন একটি জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পেয়েছে—যা ধর্মীয় নয়। পহেলা বৈশাখ একমাত্র উৎসব, যা কোনো ধর্ম বা জাতিগত বিভাজনের আওতায় পড়ে না—হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী—সবাই এই উৎসবে আনন্দে মেতে ওঠে।
এখানে শ্রেণি বা পেশাগত ভেদাভেদ নেই। কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে—সকলেই একসঙ্গে উৎসবে শরিক হয়। শত বছরেরও বেশি সময় ধরে গ্রামে, নদীতীরে, বটগাছতলায় বৈশাখী মেলা বসে এই দিনে। এই মেলাগুলিই বাঙালির হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। হাতে তৈরি নানা পণ্যের পসরা—গ্রামীণ জীবনের বৈচিত্র্য ও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। এই মেলাগুলো যেন গ্রামীণ জীবনের আয়না।
এই দিনে ব্যবসায়ীরা খোলেন নতুন হিসাবের খাতা—হালখাতা। নগরজীবনের বাইরে, গ্রামীণ বাংলায় আজও এই লোকজ প্রথাগুলি জীবিত আছে—যদিও আধুনিকতার চাপে কিছুটা মলিন হয়ে পড়েছে। তবুও, লোকসংস্কৃতির ধারায় প্রবাহমান এই উৎসব—পাতলা হলেও এখনো থেমে যায়নি।
তবে এর উল্টো চিত্রটিও উপেক্ষা করা যায় না। আজকের দিনে এই উৎসব হয়ে উঠেছে এক জটিল মানসিক উপাখ্যান—যা দিন দিন আরও জটিল হয়ে উঠছে। “আধুনিক নাগরিক সংস্কৃতি”র নামে এটি এক বিভ্রান্তিকর ও বিকৃত উৎসবে পরিণত হয়েছে। এর রূপ পাল্টেছে, উৎসবের অনেকেই ভুলে গেছে এর শিকড় ও ইতিহাস।
এই তথাকথিত “স্মার্ট” নগরজীবন, যা ঐতিহ্যবর্জিত, তা এখন বিদেশি সংস্কৃতির ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে। আমাদের পোশাক, আচরণ, চিন্তা, খাদ্যাভ্যাস, শিক্ষা—সবকিছুতেই বিদেশি প্রভাব স্পষ্ট।
ফলে, পহেলা বৈশাখ এখন অনেকটাই এক বিকৃত উৎসবে রূপ নিয়েছে। ঘরে বানানো সাদাসিধে আলু ভাজা বদলে পার্কের ফুড ট্রাকে বিক্রি হওয়া ফ্রেঞ্চ ফ্রাই হয়ে গেছে; সংসদ ভবনের সামনে বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হেঁটে বেড়ানো শর্টস পরা তরুণ-তরুণীরা সকালে বেড-টি পান করছে, কেউ কেউ খাচ্ছে আমেরিকান প্যাকেটজাত বেগুন ভাজা বা মালয়েশিয়ান প্যারাটা।
প্রশ্ন জাগে: নগরজীবন কি আমাদের লোকজ ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে ধরে রাখছে—নাকি তা বিকৃত করে দিচ্ছে?
অনেক সময়ই আমরা দেখি একধরনের সাংস্কৃতিক উন্মাদনা—অবিরাম উল্লাস আর বিশৃঙ্খল শব্দের ঢেউ, যা জাতিগতভাবে আমাদের মনস্তত্ত্বকে অস্থির করে তুলছে। আরও উদ্বেগজনক হলো পহেলা বৈশাখ নিয়ে নগরকেন্দ্রিক গণমাধ্যমের অতিরিক্ত ও বাহুল্য প্রদর্শন—যা বাস্তব বাঙালি জীবনের সঙ্গে কোনো যোগ রাখে না। প্রদর্শন বড় হয়েছে, কিন্তু বাঙালিয়ানা সেখানে নেই। যেমন: যখন টিভি চ্যানেলগুলো বৈশাখ উদযাপন করে বিকৃত ব্যান্ড সংগীত দিয়ে, তখন কল্পনা করা যায়—বিষাখা হয়তো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
রমনায় পান্তা-ইলিশের বাহারি আয়োজন থেকে শুরু করে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে ছাপানো রঙিন অনুষ্ঠানের ছবিগুলোতে নববর্ষ জাঁকজমকপূর্ণ। কিন্তু পর্দার পেছনে রয়ে গেছে সেই অগণিত অদৃশ্য মুখ, যাদের হাতে তৈরি হয়েছিল এই বর্ষপঞ্জির ছন্দ। আজ সেই সৃষ্টিশীল হাতগুলো আধা-অনাহারী, কখনো না খেয়ে—এই উৎসব থেকে বহিষ্কৃত। এক সময় যাঁদের জন্য ছিল এই উৎসব, আজ তাঁরাই এর বাইরে।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক কুষ্টিয়া ও দ্য কুষ্টিয়া টাইমস, গবেষক, লিখিত গ্রন্থ সংখ্যা-২৮/
Leave a Reply