March 24, 2025, 6:53 am
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বছরের প্রথম দিনে নতুন বইয়ে শিক্ত হতো দেশের প্রায় পাঁচ কোটির বেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু এবার নতুন বছরে বই ছাড়াই শ্রেণিকক্ষে যেতে হবে সাড়ে তিন কোটির বেশি শিক্ষার্থীকে। ৭৮৩ কোটি টাকার বেশি অর্থ গচ্চা দিয়েও নতুন বই উঠলো সব শিক্ষার্থীর হাতে। সরকারের সচ্ছিা থাকলেও এরজন্য দায়ি করা হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)কে।
অভিযোগ উঠেছে, প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যক্তিদের অদক্ষতা, বিনা কারণে দরপত্র বাতিল, বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরিতে দেরি হওয়া, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে তদারকির কাজ দিতে কালক্ষেপণ এবং মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে গড়িমসি— এসব কারণে এবার পাঠ্যবই ছাপাতে দেরি হচ্ছে।
সাধারণত ডিসেম্বরে ছাপা শেস করতে প্রতিবছরই পাঠ্যবই মুদ্রণের প্রক্রিয়া শুরু হয় জুন-জুলাই মাস থেকে। এবারও যথাসময়ে শুরু হলেও গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বই ছাপানোর সব দরপত্র কোনো কারণ ছাড়াই বাতিল করা হয়। নতুন করে দরপত্র আহ্বান করায় সরকারের ৭৮৩ কোটি টাকার বেশি অর্থ গচ্চা যাচ্ছে। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি ছিল, দরপত্র ঠিক রেখে নতুন পাণ্ডুলিপিতে তা সমন্বয় করতে। কিন্তু এনসিটিবি’র পরামর্শে মন্ত্রণালয় আগের সব দরপত্র বাতিল করে। ফলে বই ছাপানোর প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায় তিন মাস। ফলে পহেলা জানুয়ারি প্রাথমিকের কিছু শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই উঠলেও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাবে না নতুন বই ।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বলছেন, এক মাসের মধ্যে মাধ্যমিকের ৩১ কোটি বই ছাপানোর সক্ষমতা তাদের নেই। কাজ পাওয়া মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো দিনে সর্বোচ্চ (২৪ ঘণ্টা মেশিন চললে) ৪০ লাখ বই ছাপাতে পারে। সেখানে নিয়মিত কাগজ পাওয়া, মেশিন ঠিক থাকা, শ্রমিক পাওয়া, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ থাকার বিষয়টি তো রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকার পরও শুধু মাধ্যমিকের বই ছাপাতে ৪২ থেকে ৪৫ দিন সময় লাগবে। অন্যদিকে, প্রাথমিকের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপানোর কাজও বাকি রয়েছে।
এনসিটিবি’র তথ্যমতে, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ৪০ কোটি বই ছাপাতে এক লাখ ১৫ হাজার টন কাগজ প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রাথমিকে ২০ হাজার টন, বাকি কাগজ মাধ্যমিকের জন্য প্রয়োজন। বাজারে সেই কাগজের স্বল্পতা রয়েছে। এবার যে মানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানোর শর্ত দিয়েছে তা মাত্র পাঁচ-ছয়টি পেপার মিলের কাছে রয়েছে। তারা দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে ৬০০ টন সরবরাহ করতে পারছে। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেও কাগজের স্বল্পতার কারণে কাঙ্ক্ষিত বই ছাপাতে পারবে না। তাদের দাবি, বাজারের অন্য সব পেপার মিলকে কাগজ সরবরাহের জন্য আদেশ দেওয়া। অন্যদিকে, বসুন্ধরা পেপার মিলসহ আরও দুটি পেপার মিল থেকে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিরাপত্তার কারণে কাগজ নিচ্ছে না। এসব ইস্যু সমাধান না করে এনসিটিবি জানুয়ারির মধ্যে সব বই ছাপানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান গণমাধ্যমকে জানান, ‘এক মাসের মধ্যে ৩৩-৩৪ কোটি বই ছাপিয়ে দেওয়ার মতো সক্ষমতা শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর কারও নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার গাফিলতি ও খামখেয়ালিপনার কারণে আজ এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আগস্ট মাসে যখন সরকার কারিকুলাম বাতিল করল তখনই বলেছি, বিজ্ঞান ও গণিতের মতো যে সব বইয়ের কম পরিমার্জন হবে সেগুলো আগে ছাপানো জন্য। সেটি তো তারা করেনি, উল্টো কাজ বিলম্ব করার জন্য যা যা দরকার সব করেছে এনসিটিবি। বছর শেষ হওয়ার ১০ দিন আগে নোয়া দিয়ে এখন বলছে, এক মাসের মধ্যে সব বই ছাপানোর। এটা কি মামা বাড়ির আবদার?
জানা যায়, এমন পরিস্থিতিতে মুদ্রণ শিল্প সমিতির এক নেতা শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি জানুয়ারি মাসে কত সংখ্যক বই সরবরাহ করতে পারবেন এবং পাঠ্যবই মুদ্রণের সার্বিক চিত্র তুলে ধরেন। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ মুদ্রণ সমিতির নেতাদের ওপর নতুন করে চাপ প্রয়োগ করেন। একপর্যায়ে সমিতির নেতাদের মুখ থেকে জোর করে ‘জানুয়ারি মাসের মধ্যে সব বই সরবরাহ করবেন’ বলে মুচলেকা নেন। এ নিয়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে জানতে মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তাদের কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, ‘ওই দিন যা ঘটেছে তা এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ প্রায় শেষ। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বই ছাপা হয়েছে। তবে, ষষ্ঠ থেকে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপা শুরুর প্রক্রিয়াগুলো এখনও সম্পন্ন হয়নি। বেশকিছু বইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়াও বাকি আছে। এ ছাড়া কাজ শেষ করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার নির্দিষ্ট সময়সীমাও জানাতে পারেনি এনসিটিবি। বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সহজ কাজটি জটিল করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব অংশীজন কাজ করলে ধোঁয়াশার মধ্যে পড়তে হতো না কাউকে।
Leave a Reply