November 11, 2025, 7:37 am

দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/আনন্দবাজার পত্রিকা
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চড়ছিল উত্তেজনার পারদ। কিন্তু, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে দেখা গেল নয়া মোড়। সন্ত্রাসবাদ থেকে কিছুটা বাঁক নিয়ে এখন নতুন ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’ সিন্ধু জলচুক্তি! পরিস্থিতি যা, তাতে নদীর জলের জন্য পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর পুরোমাত্রায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
সিন্ধু ও তার শাখা নদীগুলির জল ভারত বন্ধ করলে পাক পঞ্জাব প্রদেশকে শুকিয়ে মরতে হবে, তা ভাল রকম জানে ইসলামাবাদ। বিশ্লেষকদের দাবি, সেই কারণে ৬৫ বছর আগের ওই চুক্তি নয়াদিল্লি স্থগিত করায় শাহবাজ় শরিফ সরকারের রীতিমতো কাঁপুনি ধরে গিয়েছে। আর তাই পাল্টা চাপ বজায় রাখতে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছে তারা।
পাকিস্তানের ফসলের বড় অংশ আসে পঞ্জাব প্রদেশ থেকে। সেখানকার সেচ ব্যবস্থার ৮০ শতাংশই সিন্ধু চুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত নদীর জলের উপর নির্ভরশীল। ভারত শেষ পর্যন্ত এই চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে গেলে মারাত্মক ভাবে ব্যাহত হবে সেই ব্যবস্থা। সে ক্ষেত্রে আর্থিক ভাবে ভাঙতে পারে ইসলামাবাদের কোমর।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের নেপথ্যে ছিল সিন্ধু নদীর জলের দখল। সেই কারণেই কাশ্মীর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বাধীন সরকার। উল্লেখ্য, গত বছর থেকেই এই চুক্তির শর্তগুলি বদলের ব্যাপারে ইসলামাবাদের উপর চাপ তৈরি করছিল ভারত।
১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খানের মধ্যে সিন্ধু নদীর জল বণ্টন নিয়ে এই চুক্তি সাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানের করাচি শহরে গিয়ে এই চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন পণ্ডিত নেহরু।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ন’বছর আলোচনার চলার পর সিন্ধু জলচুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছিল। এর মধ্যস্থতাকারী বিশ্ব ব্যাঙ্ক একটি সালিশি আদালত তৈরি করে। তবে চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে এগুলি বাধা হবে না বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
সিন্ধু জলচুক্তির প্রস্তাবনায় বলা রয়েছে, ‘‘ভারত ও পাকিস্তান সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদীগুলির জল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা ও বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। সহযোগিতামূলক মনোভাবের উপর ভিত্তি করে এই চুক্তি তৈরি করা হয়েছে।’’
সিন্ধু নদীর উৎপত্তি দক্ষিণ-পশ্চিম তিব্বতের মানস সরোবর সংলগ্ন একটি প্রস্রবণ থেকে। নদীটি লম্বায় প্রায় ৩ হাজার ১৮০ কিলোমিটার। এর তীরেই ২ হাজার ৫০০ খ্রিস্টপূর্বে গড়ে উঠেছিল হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর সভ্যতা।
তিব্বতে উৎপত্তি হওয়ার পর জম্মু-কাশ্মীরের উপর দিয়ে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে এই নদী। পঞ্জাব প্রদেশের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে শেষে দক্ষিণের বন্দর শহর করাচির কাছে আরব সাগরে গিয়ে মিশেছে সিন্ধু নদী।
সিন্ধুর মূল উপনদী হল বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, ইরাবতী ও বিপাশা। সিন্ধু জল চুক্তিতে এই নদীগুলির জলের ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও চুক্তিতে শতদ্রু নদীর জলের ব্যবহারের কথাও বলা রয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, পূর্ব দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের। অন্য দিকে পশ্চিম দিকের সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল ব্যবহার করতে পারবে পাকিস্তান। জলের নিরিখে সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদী মিলিয়ে ৩০ শতাংশ ভারত ও ৭০ শতাংশ পাবে পাকিস্তান।
পশ্চিম দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল নয়াদিল্লি যে একেবারেই ব্যবহার করতে পারবে না, এমনটা নয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে এই তিনটি নদীর জল স্থানীয় ভাবে সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারবে ভারত। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌ চলাচল ও মাছ চাষের জন্য ভারতের এই তিনটি নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।
সিন্ধু চুক্তির মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই ভূমিকায় প্রথম থেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে নয়াদিল্লি। সালিশি আদালত ভেঙে দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে ভারত। তবে এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি বিশ্ব ব্যাঙ্ক।
সিন্ধু জলচুক্তি হওয়ার পর মোট তিন বার ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে পাকিস্তান। এ ছাড়া দীর্ঘ দিন ধরেই ইসলামাবাদের মদতে উপত্যকায় চলছে সন্ত্রাসবাদ। তা সত্ত্বেও এত দিন এই চুক্তি নিয়ে সে ভাবে উচ্চবাচ্য করেনি ভারত।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সিন্ধু চুক্তির পুনর্মূল্যায়নের জন্য প্রথম বার পাকিস্তানকে নোটিস পাঠায় নয়াদিল্লি। ইসলামাবাদের তরফে সে বার কোনও সাড়া মেলেনি। গত বছর দ্বিতীয় নোটিস দেয় ভারত। তখনই নরেন্দ্র মোদী সরকার বড় পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
গত বছরের ৩০ অগস্ট সিন্ধু জলচুক্তি নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকিস্তানকে চিঠি পাঠায় ভারত। তাতে এই চুক্তিতে মূলগত পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। সীমান্ত-সন্ত্রাসের প্রভাব চুক্তির উপর পড়তে চলেছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল নয়াদিল্লি।
২০১৯ সালে পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার পর ঘনিষ্ঠ মহলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সূত্রের খবর, তিনি বলেন রক্তের স্রোত ও জলের ধারা একসঙ্গে বইতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, চুক্তি ভাঙার ব্যাপারে ওই সময় থেকে চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানিয়েছে ওয়াকিবহাল মহল।
গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের উপর নৃশংস জঙ্গি হামলার পর সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করেছে মোদী সরকার। আর সঙ্গে সঙ্গেই হুঁশিয়ারি দেয় পাকিস্তান। নদীর জলের ধারা বন্ধ হলে তা যুদ্ধ হিসাবে দেখা হবে বলে স্পষ্ট করে দিয়েছে ইসলামাবাদ। পাশাপাশি, দিয়েছে সিমলা চুক্তি স্থগিত করার হুমকিও।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের হাতে সম্পূর্ণ ভাবে পর্যুদস্ত হওয়ার পর সিমলা চুক্তিতে সই করেন তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো। এই চুক্তির মাধ্যমেই কাশ্মীরে তৈরি হয় নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অফ কন্ট্রোল বা এসওসি)। ১৯৯৯ সালের যুদ্ধে এলওসি পেরিয়ে ভারতে ঢোকার চেষ্টা করে পাক ফৌজ। ফলে এই চুক্তি স্থগিত বা বাতিল হলে নয়াদিল্লির তেমন কোনও সমস্যা হবে বলে মনে করছেন না প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।