August 3, 2025, 3:49 am

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন পোর্টাল
সংবাদ শিরোনাম :
৫ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে নারী-শিশুসহ ১৭ বাংলাদেশিকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করল বিএসএফ কার্যকর/ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক দেশে প্রতি চারজনের একজন বহুমাত্রিক দরিদ্র, শিশুদের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য বছরে ১০-১৫ শতাংশ বিশেষ সুবিধা ঘোষণা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন: মানুষের প্রকৃত আয় এখনো ঋণাত্মক হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্স/১ কোটি ৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চেয়ারম্যানসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে যশোরে মামলা গোপন তৎপরতার আশঙ্কা: ১১ দিনের ‘বিশেষ সতর্কতা’ জারি করেছে পুলিশ বিনিয়োগে স্থবিরতা, ভোগ কমেছে জুনে এলসি খোলা ৫ বছরে সর্বনিম্নে কুষ্টিয়ায় বিএনপি কর্মী হত্যা মামলায় সাবেক এসপি তানভীর আরাফাতকে গ্রেপ্তার, চলবে পূর্বের মামলা

লকডাউনে বন্ধ কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাঁজা

জাহিদুজ্জামান/

লকডাউনের কারণে বন্ধ রয়েছে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাঁজা তৈরির কারখানাগুলো। এতে অর্ধশতাধিক শ্রমিক ও কয়েকশ বিক্রেতা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন, ট্রেন-বাস চলাচল না করলে খাজার ক্রেতা পাওয়া যায় না, তাই বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। এদের অনেকেই ভ্যান-রিক্সা চালানোসহ অন্য কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন। এদিকে মজাদার ও ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের সরবরাহও বন্ধ হয়ে গেছে।

মচমচে তিলের খাজা পছন্দ করেনা এমন মানুষ খুজে পাওয়া ভার। রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ও ফেরী ঘাট ছাড়াও শহরের রাস্তায় যানজটে আটকে পড়া গাড়িতে গাড়ীতে মজাদার এই খাজা বিক্রি করতে দেখা যায়। ফেরি করে বিক্রি হয় দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও। যেখানেই বিক্রি হোক না কেন এর সবই কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা।
কুষ্টিয়ায় এখন রয়েছে ৫টি কারখানা। এরমধ্যে মিলপাড়ায় অবস্থিত ভাই ভাই তিলের খাজা কারখানাটি যেমন বড় তেমনি প্রসিদ্ধও। শহরের কবি আজিজুর রহমান সড়কে একটি, শহরতলীর ছেউড়িয়া গ্রামে ২টি এবং জয়নাবাদ গ্রামে একটি কারখানা রয়েছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় কুষ্টিয়ার তিলের খাজার নামে আরো কয়েকটি কারখানা রয়েছে বলে জানান এরসঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা।
সন্ধ্যার পর মিলপাড়ায় অবস্থিত ভাই ভাই তিলের খাজা কারখানায় গিয়ে দেখা যায় এর শ্রমিকরা হতাশ হয়ে অলস বসে আছেন। টিনের চালের বড় আকারের এই ঘর বেশ পরিপাটি সাজানো। গাদা দিয়ে রাখা আছে কাঠের খড়ি। একপাশে চিনি ও তিলের বস্তা রয়েছে। শেষের দিকে বিশালাকার চূলা ও পাতিল। কারখানার পূর্বদিকে সান করা লম্বা পাটাতন। সব পরিস্কার ঝকঝকে। লকডাউনের আগের দিন থেকে কারখানা বন্ধ হলেও মনে হচ্ছে প্রতিদিনই পরিস্কার করা হচ্ছে।
এই কারখানা চলে যৌথ মালিকানায়। এর ১০ জন মালিক নিজেরাই শ্রমিক। এদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ ইদি আমিন। তিনি সাইকেল চালিয়ে কারখানায় আসলেন। আগে থেকেই ছিলেন আরো ৪জন। তারা টেলিভিশন চালিয়ে করোনার খবর দেখা শুরু করলেন। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ায় তারা আরো হতাশ হয়ে পড়েন। সাংবাদিক জাহিদুজ্জামানকে ইদি আমিন বলেন, গত বছর করোনার শুরুতে ১মাস বন্ধ ছিলো কারখানা। তখন বসে খেয়ে সব পুজি শেষ হয়ে আরো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ি আমরা। এখন আবার শুরু হয়েছে, আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।
এই কারখানাতেই প্রতিদিন দুইশ থেকে আড়াইশ কেজি তিলের খাঁজা তৈরি হতো বলেন মালিক-শ্রমিক আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, আমরা সপ্তাহে এখান থেকে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা নিতাম সংসার খরচের জন্য।
এরই মধ্যে কারখানায় আসেন আরো কয়েকজন। তারা চেয়ার-টুল পেতে বসেন।
গতবছর করোনায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে নতুন করে শুরু করার সময় পুঁজি সংকটে পড়ি। পরে জেলা প্রশাসক ও বিসিক-এর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ সংগ্রহের চেষ্টা করি- বলছিলেন আরেকজন মালিক সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ডিসি স্যার ৩ লাখ টাকা লোন দেয়ার কথা বললেও ব্যাংক থেকে ১লাখ টাকা দিতে চায়। সাথে নানান কাগজপত্রের ঝামেলা। তাই আমরা যে যেখান থেকে পারি ৫/১০ হাজার টাকা করে ম্যানেজ করে আবার শুরু করি। সেসময় অনেকে এনজিও’র ঋণ নিয়েছেন, অনেকেই ছাগল-গরু, এটা-সেটা বিক্রি করেছেন জাহিদুজ্জামানকে বলেন চাঁদ আলী।
সাদ মোহাম্মদ বলেন, আমরা বছর শেষে লাভ লোকসান ঠিক করি। এর মধ্যে যার সংসার চলতে যতটুকু লাগে এখান থেকে খরচ হিসেবে নিই। সব লেখা থাকে। কিন্তু করোনা শুরুর পর থেকে ব্যবসা জমছে না। অর্ডার কম আসছে। লাভতো দূরের কথা, পুজি শেষ হয়ে গেছে কয়েকবার।
এদের একজন আব্দুর রাজ্জাক দিনের বেলায় ভ্যান চালাচ্ছেন। রাতে আসেন কারাখানায় দুঃখের সাথী হতে। তিনি বলেন, কেউ হেল্প করেনি। মজাদার তিলের খাজা খেয়ে তৃপ্তি পান সবাই। কিন্তু আমরা কীভাবে চলি তার খোঁজ নেয় না কেউ।
সারোয়ার হোসেন বলেন, ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলে খাঁজা বিক্রি হয় না। তাই সবগুলো কারখানাই এখন বন্ধ রয়েছে।
খুললে আবার চালু করবেন কীভাবে? জাহিদুজ্জামানের এ প্রশ্নের জবাবে হামিদুল ইসলাম বলেন, আমরা যতো কস্টেই থাকি মহাজনের খাতা ক্লিয়ার রাখি। মহাজন বলতে তিনি বোঝান, তিল, চিনি এবং খাজার প্যাকেট ও লেবেল সরবরাহকারীদের। এরা বাঁকীতে মাল দেবে আমাদের। আমরা আবার শুরু করতে পারবো। আরো কিছু টাকা লাগবে- যেভাবেই হোক তা আনতে হবে। সরকারি সহায়তা চান কি-না এ প্রশ্নের জবাবে প্রায় সবাই হতাশা প্রকাশ করেন। বলেন, লোনই পাই না আবার সহায়তা।
এই কারবারের সঙ্গে যুক্ত আরো দুজন হলেন মো. শাহীন ও সেলিম হোসেন।
এসব কারখানা থেকে ভোর বেলা কেজি হিসেবে খাজা কিনে নিয়ে যান বিক্রেতারা। তারা রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ও ফেরী ঘাট ছাড়াও শহরের রাস্তায় যানজটে আটকে পড়া গাড়িতে গাড়ীতে মজাদার এই খাজা বিক্রি করেন। অনেকেই ফেরি করে বিক্রি করেন প্রত্যন্ত গ্রামেও। কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা পাওয়া যায় মিষ্টি ও স্টেশনারী দোকানেও। ফেরি করা বিক্রেতারাও বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকেই রিক্সা চালাচ্ছেন। ফকির লালন শাহের আখড়াবাড়ির সামনে দেখা মেলে এমন একজনের। মো. সবুজ বাসস্ট্যান্ড এবং ট্রেনের মধ্যে তিলের খাজা বিক্রি করতেন। তিনি বলেন, খাজা বেচে ৬/৭ শ টাকা লাভ থাকতো। মানুষ আগ্রহ করে কিনতো, ভাল লাগতো।
খাজার কারবারী ইদি আমিন বলেন, ১৯৭৫ সালে তারা ১৩ জন একসঙ্গে ভাই ভাই নামের এই কারখানা করেন। এরমধ্যে মারা গেছেন কেউ, কেই অসুস্থ হয়ে বাদ গেছেন। কেউ আবার অন্য কাজে চলে গেছেন। নতুন অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। এখন ভাই ভাই কারখানাতেই আছি আমরা ১০ জন। সব মিলিয়ে কুষ্টিয়ার ৫টি কারখানায় এমন ৪৫ থেকে ৫০ জন লোক কাজ করে।
ইদি আমিন বলেন, প্রায় ৬০ বছর আগে কুষ্টিয়া শহরতলীর ছেউড়িয়া গ্রামে মাড়োয়ারি স¤প্রদায়ের লোকজন গুড় দিয়ে তিলের খাজা তৈরি করতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ওই মাড়োয়ারীরা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। দেশ স্বাধীন হবার ওইসব কারখানায় কাজ করা স্থানীয় মুসলমানদের কয়েকজন শ্রমিক নিজেরাই চিনি দিয়ে খাজা তৈরি শুরু করেন। সেই থেকে শুরু। দিন দিন মচমচে সুস্বাদু এই তিলের খাজার কদর বাড়তে থাকে। শীতকালে চাহিদা বেশি থাকে।

কীভাবে তৈরি হয় তিলের খাজা?
কারবারীরা জানান, খাজা কারখানায় কাজ শুরু হয় সন্ধ্যা থেকে। বড় পাত্রে চিনি ও দুধ গুলিয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বালিয়ে লই তৈরি করা হয়। লই ঠান্ডা হলে একটি আংটার সাথে বাধিয়ে বারবার টেনে এর রং সাদা করা হয়। সেখান থেকে নিয়ে দুইজন মিস্ত্রি লই এর দুই মাথা ধরে নিপুণ দক্ষতায় বারবার টানাটানি করে এর মধ্যে ফাকা জায়গা সৃষ্টি করে। এরপর লম্বা করে টেনে বিছিয়ে পিস পিস করে কেটে তার সাথে তিল মেশালেই হয়ে মজাদার তিলের খাজা।
রাতভর কারখানায় চলতে থাকে খাজা তৈরির কাজ। আর দুর দুরান্ত থেকে আসতে থাকে পাইকারি ক্রেতার দল। সারাদেশে এই তিলের খাজার কদর বাড়তে থাকায় দিনদিন কারখানার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৩০টি কারখানায় এখন তিলের খাজা তৈরি হয়। এর সবগুলোরই মালিক, মিস্ত্রি ও শ্রমিক সবাই কুষ্টিয়ার। আর যেখানেই তৈরি হোক না কেন প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরোনো খবর এখানে,তারিখ অনুযায়ী

Mon Tue Wed Thu Fri Sat Sun
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  
© All rights reserved © 2024 dainikkushtia.net
Maintenance By DainikKushtia.net