August 3, 2025, 2:04 pm
শুভব্রত আমান, কুষ্টিয়া/
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর স্বচ্ছতা ছাড়া কোনো খনন বা উন্নয়ন প্রকল্প যে বারবার ব্যর্থ হয়—তার বাস্তব উদাহরণ হয়ে উঠেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম প্রধান নদী গড়াই। এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মার শাখা নদী গড়াই এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে। দীর্ঘ সাত বছর ধরে খনন ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প চললেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সুফল। বরং শুষ্ক মৌসুমে গড়াইয়ের বুক জুড়ে জেগে উঠছে ধু-ধু বালুচর, যা হুমকির মুখে ফেলেছে সুন্দরবনের মিঠা পানির ভারসাম্য, কৃষি, জীববৈচিত্র্য এবং কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা।
গড়াই নদী পদ্মার একটি শাখা। কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া এবং সদর উপজেলার হরিপুরে এর উৎসমুখ। এই নদী কুষ্টিয়া ছাড়াও ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোরসহ বেশ কয়েকটি জেলা হয়ে দক্ষিণে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০টি জেলার কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও লবণাক্ততা রোধে গড়াইয়ের রয়েছে অপরিহার্য ভূমিকা।
এ নদীর সঙ্গে সরাসরি জড়িত স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা। কিন্তু বর্তমানে দখল, দূষণ ও ভরাটের ফলে অনেক স্থানে নদীটির নাব্যতা হারিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও তা সরু খালে পরিণত হয়েছে।
গড়াই নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ পর্যন্ত প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত খননের কয়েকটি ধাপ ও ব্যয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
প্রথম খনন: ১৯৯৭ সালে ৪২০ কোটি টাকা
দ্বিতীয় ধাপ: ১৯৯৯ সালে ২৭৪ কোটি টাকা
তৃতীয় ধাপ: ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৯৪২ কোটি টাকা
বর্তমান প্রকল্প: ৫৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে চার বছর মেয়াদি প্রকল্প, শুরু ২০১৮ সালে, মেয়াদ শেষ জুন ২০২৫
এ ছাড়া, চলতি বছর প্রকল্পের আওতায় ২০ কিলোমিটার এলাকা খনন করে ৪৪.৫৮ লাখ ঘনমিটার বালু অপসারণের কাজ চলছে। প্রকল্পে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৯২ লাখ ঘনমিটার সিলকোট উত্তোলন করা হয়েছে।
বাস্তবায়নে অনিয়ম ও ব্যর্থতা/
প্রকল্প শুরু থেকেই ড্রেজিং ও বালু ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ড্রেজিংকৃত সিলকোট নিরাপদ স্থানে সংরক্ষণ না করে অনেকক্ষেত্রে নদীতেই ফেলে রাখার কারণে সেগুলো আবার তলদেশে জমে নদী পুনরায় ভরাট হয়ে পড়েছে। এর ফলে খনন কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত সুফল আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় গড়াই নদীর বাম তীরে হরিপুর-কুষ্টিয়া সংযোগ সেতু সংলগ্ন ৩৭০ মিটার দৈর্ঘ্যের তীর সংরক্ষণ কাজ চলছে, যার ব্যয় ১২ কোটি ৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবস্থান/
পাউবো’র দাবি, প্রকল্পের মূল টার্গেট পূরণ হয়েছে। এখন নদীতে টেকসই নাব্যতা বজায় রাখতে হলে প্রতিবছর সিলকোট অপসারণ করতে হবে। তবে তারা স্বীকার করছে, অর্থ বরাদ্দে বিলম্ব এবং সিলকোট সংরক্ষণের জায়গার অভাবে কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
স্থানীয় উদ্বেগ ও জলসংকট
গড়াই নদী কেবল একটি পানি প্রবাহ নয়, এটি কুষ্টিয়াসহ সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ ও জীবনের নির্ভরযোগ্য ভরসা। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কালীগঙ্গা, কালীসহ বেশ কয়েকটি ছোট নদী। বর্তমানে পানির স্তর এতটাই নিচে নেমে গেছে যে, শহর ও গ্রামে হাজার হাজার নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। কুষ্টিয়া পৌরসভার হিসাব মতে, ৩৭ হাজার হোল্ডিংয়ের মধ্যে অধিকাংশ বাড়ির নলকূপে পানি উঠছে না।
জীববৈচিত্র্য ও সুন্দরবনের হুমকি/
গড়াই নদী সুন্দরবনের মিঠা পানির প্রধান উৎসগুলোর একটি। নদীটির মাধ্যমে প্রবাহিত মিঠা পানি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে লবণাক্ততার ভয়াবহতা থেকে। তবে নদীটির নাব্যতা হারানোর কারণে সুন্দরবনসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় পানির সংকট ও পরিবেশগত ভারসাম্য হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের কুষ্টিয়া জেলার সভাপতি খলিলুর রহমান মজু বলেন, “গড়াইয়ের এই অবস্থার দায় শুধু প্রকল্প বাস্তবায়নের নয়, বরং রাষ্ট্রের নদীনীতির ব্যর্থতার প্রতিফলন।”
সম্মিলিত সামাজিক জোটের চেয়ারম্যান ড. আমানুর আমান বলেন,“গড়াই নদী শুধু একটি প্রকল্প নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের রন্ধ্রে গাঁথা জীবনরেখা। তাই একে রক্ষায় চাই সময়োপযোগী পরিকল্পনা, টেকসই তদারকি, দুর্নীতিমুক্ত বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। তা না হলে গড়াই ইতিহাসে সীমাবদ্ধ থাকবে, জীবন থেকে হারিয়ে যাবে।”
কী হতে পারে সমাধান
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কেবল খনন নয়, নদী পুনরুদ্ধারের জন্য চাই একটি বহুমাত্রিক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে—
নিয়মিত সিলকোট অপসারণ ও সংরক্ষণ, অবৈধ দখল ও দূষণ বন্ধ, পদ্মার সঙ্গে গড়াইয়ের সংযুক্তি নিশ্চিতকরণ, নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা টেকসই রাখা, স্থানীয় জনসম্পৃক্ততা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ।
গড়াই খনন প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈকত বিশ্বাস বলেন,“সুন্দরবন রক্ষায় নিয়মিত খনন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বর্ষায় জোয়ারের পলি জমে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, তাই প্রতিবছরই ড্রেজিং অপরিহার্য।”
Leave a Reply