November 22, 2024, 1:07 am
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থীর দেয়া হলফনামায় নিজেদের সম্পদের বর্ণনা দিয়েছেন কুষ্টিয়ার দুই হেভিয়েট নেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও কুষ্টিয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু ও কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া ইনুর হলফনামা এবং দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা পর্যালোচনা করে জানা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইনুর নগদ টাকা ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। বর্তমানে তার নগদ টাকার পরিমাণ ৩ কোটি ৫৬ লাখ ১৫৫ টাকা। গত ১০ বছরের ব্যবধানে ইনুর নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় ৫২ গুণ। এই সময়ে ইনুর স্ত্রীরও নগদ টাকা বেড়েছে।
টানা তিনবার মহাজোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে একবার সরকারের তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
হলফনামার তথ্য বলছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হাসানুল হক ইনুর বার্ষিক আয় ছিল ৩৪ লাখ ৬১ হাজার ৬২৩ টাকা। স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার ১৬১ টাকা। তার স্ত্রী আফরোজা হকের সম্পদ ছিল ৭৭ লাখ ২৯ হাজার ২৩৫ টাকা। ৫ বছরের ব্যবধানে ইনুর বার্ষিক আয় কমে দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার ৪০৪ টাকা। তবে সম্পদের পরিমাণ তিন গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ ৫৬ হাজার ২২৯ টাকা। তার স্ত্রীর সম্পদ তিনগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৮৫ লাখ ৫২ হাজার ২৫৮ টাকা।
ইনুর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ টাকা আছে গাড়ি বিক্রির ১ কোটি ৫৮ লাখ ১৫৫ ও ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। গত নির্বাচনের সময় নগদ টাকা ছিল ৫০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৬। আর ১০ বছর আগে নির্বাচনের সময় ছিল মাত্র ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এবার তার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে ১৪ লাখ ৮৪ হাজার ৯২৪ টাকা, ৫ বছর আগে ছিল ৪৪ লাখ ৫১ হাজার ৪৮০ টাকা। ১০ বছর আগে ছিল ৩৬ লাখ ৭০ হাজার ১৫৬ টাকা।
ইনুর স্ত্রী আফরোজা হকের নগদ টাকা বেড়েছে আরও বেশি। এখন তার নগদ টাকা আছে ১ কোটি ৬১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪৩ টাকা। ৫ বছর আগে ছিল ৬০ লাখ ৩ হাজার ২৫৮ টাকা। আর ১০ বছর আগে ছিল মাত্র ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৯০ টাকা। স্ত্রীর নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা আছে ১৬ লাখ ৩৭ হাজার ২৭০ টাকা। ৫ বছর আগে ছিল ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৭ টাকা। আর ১০ বছর আগে ছিল মাত্র ৮০ হাজার ৪৯৩ টাকা।
তার আয়ের বড় অংশ আসে ব্যবসা, বেতন-ভাতা, ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ও টিভি টক শো থেকে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইনু হলফনামায় ব্যবসা থেকে বার্ষিক ৭ লাখ ৬২ হাজার ১৫৯, বেতন-ভাতা থেকে ২৩ লাখ ৯৬ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং টিভি টক শো ও ব্যাংক সুদ থেকে ২ লাখ ১৬ হাজার ৭০ টাকা আয় দেখিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার বার্ষিক আয় ৩৩ লাখ ৭৪ হাজার ৮০৪ টাকা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি ৩৪ লাখ ৬১ হাজার ৬২৩ টাকা আয় দেখিয়েছিলেন। ১০ বছর আগে ছিল ২৬ লাখ ৩৬ হাজার ৭৮২ টাকা।
সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ১৯৪৬ সালের ১২ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপনগর গ্রামে।
অনদিকে, গত ৫ বছরে হানিফের বার্ষিক আয় বাড়লেও কমেছে সম্পদের পরিমাণ। ঋণ রয়েছে ১০২ কোটি ৮৬ লাখ ১১ হাজার ৭০০ টাকা। বার্ষিক আয় ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৪ হাজার ১০ টাকা। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২০ কোটি ৯৯ লাখ ১৬ হাজার ১১১ টাকা। নগদ টাকা রয়েছে ২ কোটি ১৬ হাজার ৪৫২ টাকা। তবে হানিফের হলফনামায় তার স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের কোনো তথ্য নেই।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে হানিফের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় থেকে জানা যায়, চারটি ব্যাংকে ১০২ কোটি ৮৬ লাখ ১১ হাজার ৭০০ টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে তার। ‘দায়’-এর ঘরে তিনি উল্লেখ করেছেন, প্রিমিয়াম ব্যাংকে লোন ৪৭ কোটি ৪২ লাখ ৭৮ হাজার ৩২৪ টাকা। ক্রেডিট কার্ডসহ ন্যাশনাল ব্যাংকে লোন ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩৪৫ টাকা, সিকিউরিটি ডিপোজিট ফার্ম হাউস প্রোপার্টিতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এনসিসি ব্যাংকে লোন ৫০ কোটি ৩ লাখ ৬ হাজার ৩১ টাকা।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ৬৯ লাখ ৫১ হাজার ১৬১ টাকা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী- তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ২০ কোটি ৯৯ লাখ ১৬ হাজার ১১১ টাকা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী- হানিফের ১২ কোটি ২২ লাখ ৮৮ হাজার ৫৮০ টাকার স্থাবর সম্পদ রয়েছে। তার স্থাবর সম্পদের মধ্যে গাজীপুর দক্ষিণ বড়ই বাড়ি এলাকায় অকৃষি জমি আছে ৩ একর। যার দাম উল্লেখ করা হয়েছে ১ কোটি ৯৮ লাখ। কুষ্টিয়ার চৌড়হাস এলাকায় ০.১২৩১ একর জমি ও তৃতীয় তলা বাড়ি রয়েছে। যার দাম উল্লেখ করা হয়েছে ১ কোটি ৯৬ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ঢাকার গুলশানে ৫ কাঠা ৯ ছটাক ২৫ স্কয়ার ফিট জমি রয়েছে। যার দাম ৩ কোটি ৩৯ লাখ ১৭ হাজার ১৮০ টাকা। নয়াপল্টনে একটি বাড়ি আছে যার মূল্য ৮ লাখ টাকা। শেয়ার বাজারে ৬ প্রতিষ্ঠানে হানিফের বিনিয়োগ আছে ৪ কোটি ৮১ লাখ ৬ হাজার ৪০০ টাকা।
হানিফের অস্থাবর সম্পদ রয়েছে ৮ কোটি ৭৬ লাখ ২৭ হাজার ৫৩১ টাকার। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে হানিফের নগদ টাকা রয়েছে ২ কোটি ১৬ হাজার ৪৫২ টাকা। কোম্পানির শেয়ার বা বন্ড ৪ কোটি ৮১ লাখ ৬ হাজার ৪০০ টাকা। রয়েছে তিনটি গাড়ি। যার মূল্য এক কোটি ৭৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা। ৩০ তোলা স্বর্ণ রয়েছে, যার মূল্য ৮ লাখ টাকা। টিভি, ফ্রিজ, এসি ৯ লাখ ১৫ হাজার ৬০০ টাকা। ২ লাখ টাকার খাট, সোফা ও অন্যান্য আসবাবপত্র রয়েছে। এ ছাড়া ২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৯ টাকা মূল্যের এনপিবি পিস্তল, ২২ বোর রাইফেল এবং ১২ বোর রাইফেল রয়েছে তার।
সম্পদ কমলেও হানিফের বার্ষিক আয় বেড়েছে। তার বার্ষিক আয় ৩ কোটি ৬৪ লাখ ৪ হাজার ১০ টাকা। এর মধ্যে বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান ভাড়া বাবদ আয় ৯ লাখ টাকা, ব্যবসা থেকে বাৎসরিক আয় ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ৩৬ টাকা। চাকরি (এমপি ভাতা) ৬ লাখ ৬০ হাজার, ব্যাংক ইন্টারেস্ট ৯৭৪ টাকা।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তার বার্ষিক আয় ছিল ২ কোটি ৩২ লাখ ৫৬ হাজার ৭৩৮ টাকা।
মাহবুব উল আলম হানিফের পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ষোলদাগ গ্রামে। তার বাবা রেলওয়ের কর্মকর্তা থাকার সুবাদে তিনি পাকশী রেলওয়ে কলোনীতে বড় হয়েছেন। সেখানে তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবনে তিনি সক্রিয়ভাবে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-২ আসনে (মিরপুর-ভেড়ামারা) দলীয় সংসদ প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে পুনরায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ২০০৭ সালের সংসদ নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী কুষ্টিয়া-১ আসনে (দৌলতপুর) দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত হলেও দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উক্ত নির্বাচন স্থগিত করা হয়। ২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-২ আসনে দলের মনোনীত প্রার্থী হলেও জোটগত নির্বাচনের স্বার্থে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
২০১৪ সালের ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-৩ আসন থেকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের ১৮তম কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো হানিফ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ লাভ করেন। পরবর্তীতে ২০১২, ২০১৬, ২০১৯ ও ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত ১৯, ২০, ২১ ও ২২ তম কাউন্সিলেও তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাহবুবউল আলম হানিফ।
Leave a Reply