March 18, 2025, 8:12 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
শেখ হাসিনার পতনের ইউনুস সরকার ভারতবিরোধিতা ও এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা তরে। ভারতের উপর নির্ভরতা কমানোর বক্তব্য জোরে জোরে বলা হয়। বিশেস করে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এই বাগাড়ম্বর ছিল দেখার মতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, পণ্য আমদানিতে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা আরো বেড়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে ভারত থেকে আমদানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ।
ভারতে অর্থবছরের হিসাব শুরু হয় এপ্রিল থেকে। দেশটির শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ ভারতীয় অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (এপ্রিল-জানুয়ারি) বিশ্বব্যাপী ভারতের পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। যদিও এ সময় বাংলাদেশে ভারতের পণ্য রফতানি বা ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর গত জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী ভারতের পণ্য রফতানি সংকুচিত হয়েছে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। যদিও একই সময়ে দেশটি থেকে বাংলাদেশে পণ্য রফতানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ।
ভারতীয় অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের অর্থমূল্য ছিল ৯৩৯ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জানুয়ারি সময়ে আমদানি হয়েছে ৮৮০ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের পণ্য। শুধু গত জানুয়ারিতেই ভারত থেকে বাংলাদেশ পণ্য আমদানি করেছে ১০৭ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। আর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আমদানি হয়েছিল ৯১ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের।
ভারতের বাণিজ্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটি থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় তুলা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খাদ্যশস্য। এছাড়া আমদানি হয় খনিজ ও জ্বালানি পণ্য, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবা। আর বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি হওয়া প্রধান পণ্য হলো তৈরি পোশাক।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা ক্রমেই বাড়তে দেখা যাচ্ছে। তবে কয়েক বছর আগে শুল্ক বাড়িয়ে দেয়ায় দেশটি থেকে চাল আমদানি ব্যাহত হয়েছে দীর্ঘদিন। দেশটিতে চাল রফতানি শুল্ক কমিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে ব্যক্তি খাতের আমদানীকৃত ভারতীয় চাল। এরপর গত বছরের ৪ ও ১৮ ডিসেম্বরে দুই দফায় সরকারিভাবে মোট ১ লাখ টন নন-বাসমতী সিদ্ধ চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। এর ভিত্তিতে অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জি-টু-জির ভিত্তিতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আনা চাল বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু হয় গত ২৬ ডিসেম্বর। এরপর জানুয়ারির মাঝামাঝি দেশটি থেকে আরো ৫০ হাজার টন চাল সরকারিভাবে আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেশটি থেকে আরো ৫০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয় সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। একই সঙ্গে অব্যাহত রয়েছে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিও। এজন্য অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাল আমদানি ও বাজারজাত করার সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
বৈরিতা থাকলেও অর্থনৈতিক বাস্তবতা অস্বীকারের সুযোগ কোনো দেশেরই নেই বলে মনে করছেন বিশেষ্জ্ঞরা। তারা বলছেন, এটাই হলো বাস্তবতা। যেমন চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সংঘাত হয়েছে দোকলাম ভ্যালিতে। রীতিমতো সরাসরি সংঘাত হয়েছে। কিন্তু দুই বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিকে তাকালে দেখা যায় তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ব্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের উদাহরণও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবেই হুমকি হিসেবে চীন ও রাশিয়াকে মোকাবেলার কথা বলা আছে। তার পরও অর্থনৈতিক সম্পর্কসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বিষয় তারা রাজনৈতিকীকরণ করে না। অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্বায়নের বর্তমান যুগে বা আন্তঃনির্ভরশীলতার যুগে অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকারের সুযোগ নেই। আমি মনে করি জনমানসে এক ধরনের ধারণা থাকবেই। কিন্তু যারা নীতি প্রণয়নকারী, যারা দেশ পরিচালনা করবেন; অনেক বিষয়েই তাদের খুব বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে জায়গায় পরিপক্বতা প্রয়োজন হয়। সেখানে অর্থনৈতিক যুক্তির বিষয় থাকে।’
প্রতিবেশী দেশটি থেকে বাংলাদেশ এখন বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেলও আমদানি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের মধ্যেই ভারত থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছিল। এ আমদানির ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গত জানুয়ারির মাঝামাঝি ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টন ডিজেল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এতে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এ ডিজেল আমদানি করার কথা।
বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের অবদান ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রাত ৯টায় জাতীয় গ্রিডে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৭৫৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে সরবরাহ ছিল ৭৬০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে আদানির কাছ থেকে নেয়া বিদ্যুতের খরচ পড়ছে তুলনামূলক বেশি। ডলার সংকটের কারণে বকেয়া বিল জমে যাওয়ায় গত বছরের ৩১ অক্টোবর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয় আদানি। এতে বাংলাদেশে গ্রুপটির গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে আসে। শীতে চাহিদা কম থাকায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও একটি ইউনিট থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বলা হয়েছিল আদানিকে। এ অবস্থায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে আদানি গ্রুপ। তবে আসন্ন গ্রীষ্মকালের চাহিদা পূরণের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবারো পুরো সক্ষমতা (১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট) অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আদানিকে অনুরোধ করা হয়েছে।
Leave a Reply